পোশাক শিল্পের এক স্মরনীয় দিন আজ

চার বছরেও ক্ষতিপূরণ পায়নি তাজরীনের শ্রমিকেরা

টিপু সুলতান (রবিন), নিজস্ব প্রতিবেদক | আজ থেকে ৪ বছর আগে এই দিনটিতে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় তোবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশন নামের পোশাক কারখানার নিচ তলায় থাকা তুলার গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। মুহূর্তের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখা নিচ তলা থেকে ৫ তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এসময় বিভিন্ন ফ্লোরে থাকা প্রায় হাজার খানেক শ্রমিক জীবন বাচাতে দিকবিদিগ ছুটাছুটি শুরু করে। অনেকে ছাদ থেকে, জানালা দিয়ে লাফিয়ে বা ভবনের পাইপ বেয়ে জীবন বাচাতে পারলেও ১১৩ জন শ্রমিকের জীবনের আলো কেড়ে নেয় আগুনের লেলিহান শিখা। আর আহত হয় প্রায় তিন শতাধিক শ্রমিক। সেদিনের আগুনের লেলিহান শিখা হয়তো অনেক হতভাগা শ্রমিকের জীবনের আলো নিভিয়ে দিতে পারেনি। কিন্তু সে দিনের ভয়াবহ স্মৃতি আজও তাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। অনেকে আবার ঘুমের মধ্যেও আগুন আগুন বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ৪ বছর পার হলেও এখনো অনেক আহত শ্রমিক পায়নি সরকার ও বিজেইএমই ঘোষিত আর্থিক সহায়তা। আবার আহত অবস্থায় বেঁচে থেকেও সুচিকিৎসার অভাবে আমেনা বেগম, সুমাইয়া ও শাহানাজ বেগম মারা যায়। এতে করে বেশির ভাগ শ্রমিকরা কোন প্রকার চিকিৎসা না করাতে পেরে কেউ কেউ মৃত্যু ভয়ে দিন কাটাচ্ছে।এতে করে ন্যায্যক্ষতি পূরণ বা সুচিকিৎসার অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে তাজরিনে ক্ষতিগ্রস্থ আহত শ্রমিকেরা।

কেমন কাটছে আহত শ্রমিকদের দিন? কি বা চায় তারা? আওয়ার নিউজ বিডি’র প্রতিবেদক কথা বলেছেন তাজরীনে আহত কয়েকজন শ্রমিকের সাথে।আলাপচারিতার অংশ-বিশেষ নিম্নে দেওয়া হলো__

dsc_0102-1

অপারেটর রেহানা বেগম

তাজরীন অগ্নিকান্ডের ঘটনায় পরিবারের চার সদস্যকে হারিয়েছেন পোশাক শ্রমিক রেহানা বেগম। ভবনটির তিন তলা থেকে লাফিয়ে পরে গুরুতর আহত হন তিনি। অগ্নিকান্ডের চার বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত উপযুক্ত ক্ষতিপূরন পাননি তিনি। আর্থিক অভাবে বাধ্য হয়েছেন নিজের মেধাবী দুই সন্তানের লেখা-পড়া বন্ধ করে দিতে। মাত্র আড়াই লক্ষ টাকা আর্থিক সহায়তা পেলেও চিকিৎসা বাবদ ধার করা দুই লক্ষ টাকা ঋণ শোধেই ফুরিয়ে গেছে সব। ভ্যান চালক স্বামীর একমাত্র আয় দিয়ে কোন মতে দিন চলছে তাদের।

অপারেটর জরিনা বেগম, কাজ করতেন পাঁচ তলায় :

তাজরীনের অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ভবনটির তিনতলা থেকে ঝাপিয়ে পরে প্রাণে বেঁচে গেলেও স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হয়নি পোশাক শ্রমিক জরিনা বেগমের। পাঁচদিন পর জ্ঞান ফেরার পর প্রাণে বেঁচে গেলেও নিজের বোনকে চিকিৎসার অভাবে গত বছর কোরবানীর ঈদের নয়দিন পর মৃত্যু হয় ছোট বোন শাহনাজ বেগমের। ভবনটির পাঁচ তলায় কাজ করা শাহনাজ বেগম ক্যান্সারে ধুকে ধুকে মরে গিয়ে বেঁচে গেলেও তার অবুঝ দুটি সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় চোখে অন্ধকার দেখেন জরিনা বেগম। দান কিংবা অনুদান নয় ন্যায্য ক্ষতিপূরন পেলেই জীবনটাকে গুছিয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি আজও।

প্রোডাকশন সুপারভাইজার মিরাজুল ইসলাম, কাজ করতেন পঞ্চম তলায় :

পাঁচ তলার প্রোডাকশন সুপারভাইজার মিরাজুল ইসলাম অগ্নিকান্ডের দিন ভবনের পাঁচ তলা থেকে লাফিয়ে পরে বেঁচে গেলেও মেরুদন্ড-পা ও হাতে আঘাত পান তিনি। বিভিন্ন সংগঠন থেকে পাওয়া প্রায় আঠারো লক্ষ টাকা আর্থিক সহায়তা পেয়ে এলাকায় মুদি দোকান খুলে চালাচ্ছেন তার জীবন-জীবিকা। তবে এমন সৌভাগ্য তার অন্যান্য সহিকর্মিদের হয়নি উল্লেখ করে অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে ন্যায্য ক্ষতিপূরন প্রদানের দাবি জানান তিনি।

%e0%a6%9c%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%97%e0%a6%ae

সইং অপারেটর নাসিমা বেগম, কাজ করতেন চার তলায় :

অগ্নিকান্ডের রাতে সহকর্মিদের সহায়তায় সন্তানদের টানে তৃতীয় তলার জানালার গ্রীল ভেঙ্গে লাফিয়ে পরে বেঁচে যান পোশাক কর্মি নাসিমা বেগম। লাফিয়ে পরে হাত ভেঙ্গে যাওয়াসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতপ্রাপ্ত হলেও ন্যায্য ক্ষতিপূরন তিনি আজও পাননি বলে তার দাবী। নিজের চিকিৎসায় ভিটেমাটি বিক্রী করলেও সন্তানদের নিয়ে অনিশ্চয়তার আশংকা তার।

ইয়াসিন শেখ চিকিৎসা অভাবে মারা যাওয়া শাহানাজ বেগমের স্বামী…

তাজরীনের অগ্নিকান্ডের ঘটনায় গুরুতর আহত পোশাক শ্রমিক স্ত্রী শাহনাজ বেগমের চিকিৎসার অভাবে ধুকে ধুকে মৃত্যুর পর নিজেও অসুস্থ্য হয়ে পরেছেন পোশাক শ্রমিক ইয়াসিন শেখ। অসুস্থ্য শরীরে পোশাক কারখানার চাকরী ছেড়ে দিয়ে দুই অবুঝ সন্তানকে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অপেক্ষায় তিনি।

এখনও অনেক আহত শ্রমিক আছে যারা নূ্ন্যতম সহয্য কিংবা অনুদান টুকুও পাননি ক্ষতিপূরন তো দূরের কথা।

কেউ, কেউ তো সংবাদ কর্মীর সাথে কথা বলাতেও অনিহা প্রকাশ করেছেন আর দূর থেকে বলেছেন, বছরে একদিন ভাষন নিতে আহেন, সারা বছর কেও খুজ ও রাখেন না।৪ বছর অইল কি করতে পারছেন আমাগো লিগ্যা? চিকিৎসা টা তো পেরের কথা তিন বেলা ঠিকমত ভাত জুটাইতে পারি না।আমাগো কষ্ট দেহনের লিগ্যা কেও নাই,গামেন্টন্স এ চাকরি কইরা আমরা পাপ করছিলাম তাই আল্লায় আমাগো এই সাজা দিছে।

dsc_0114

এদিকে তাজরিন ট্রেজিডির চার বছর পূর্ণ হলেও কোন শ্রমিক নয্যক্ষতি পূরণ না পাওয়ায় আওয়ার নিউজ বিডিকে হতাশা প্রকাশ করে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাংগঠনিক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, চার বছর পূর্ণ হলেও তাজরীন অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরন ও পূনর্বাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা হয়নি উল্লেখ করে অবিলম্বে ন্যায্য ক্ষতিপূরন প্রদানের দাবী জানান তিনি।

পরিশেষে, অতি দ্রুত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে এমনটাই প্রত্যাশা তাজরীনের আগুনে আহত শ্রমিকসহ নিহতদের স্বজনদের।



মন্তব্য চালু নেই