চাটমোহরে নিরলস সংগ্রামী সফল নারী নূরুন্নাহার ফ্যাশন ও টেইলারিং হাউজে পথ দেখাচ্ছেন

পাবনার চাটমোহর উপজেলার ভাদরা গ্রামের ছোট একটি উঠোনে খেঁজুরের পাটিতে বসে আছেন ৬-৭ জন ভিন্ন বয়সী নারী। তাদের সামনে নানা রংয়ের কাপড়, কাগজ আর কেঁচি। পাশেই একটি সেলাই মেশিন। সামনে চশমা চোখে এপলিকের কাজ করা সালোয়ার-কামিজ পড়া মধ্য বয়সী এক নারী। তিনিই সেলাই ও এপলিকের কাজ শেখাচ্ছেন ওই নারীদের। নাম নূরুন্নাহার। এভাবেই তিনি তার মতো নারীদের আত্মনিভর্র হতে পথ দেখাচ্ছেন দীর্ঘদিন।

স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। নূরুন্নাহার ১৮ বছর ধরে নিরন্তর সংগ্রাম করছেন। সে সংগ্রাম তাকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এখন তিনি গ্রামের অবহেলিত নারীদের তার মতো করে দাঁড়াবার উপায় শিখিয়ে দিচ্ছেন। বিনা পারিশ্রমিকে সেলাই ও নারী- শিশুর পোষাক তৈরি এবং তাতে এপলিকের কাজটিও প্রশিক্ষণ দিয়ে শিখিয়ে দিচ্ছেন। তার এই সাফল্যের স্বীকৃতিও মিলেছে। উপজেলায় শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।

আর দশ জন নারীর মতোই আবার বিয়ে করে সংসারী হতে পারতেন। সে বয়সও তার ছিলো তখন। কিন্তু তা করেননি নুরুন্নাহার। বাবা ও ভাইদের সংসারের বোঝাও হতে চাননি এই সাহসী নারী। ৪ বছরের ছেলে নাঈমকে কোলে নিয়ে শুরু করেন এক অন্যরকম জীবন সংগ্রাম। ৯৬ থেকে ২০১৫। ১৯ বছরের নিরলস সংগ্রামে সফল নূরুন্নাহার। এখন এলাকায় তার মতো অসহায় দুঃস্থ নারীদের পথ দেখাচ্ছেন স্বাবলম্বী হতে। গড়ে তুলেছেন মফস্বলের অচলায়তনে ফ্যাশন ও টেইলারিং হাউজ। সেখানেও ২০ নারীর করেছেন কর্মসংস্থান। দারুণ সব নক্সা করা সুঁতির এপলিক পোষাক তৈরি করছেন তারা।

চাটমোহর-পাবনা সড়কের পাশে উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের ভাদড়া স্কুলপাড়া গ্রামে নূরুন্নাহারের নিজের কেনা বাড়ীতে থেকে কিলো খানেক দূরে এলাকারই খড়বাড়ীয়া পশ্চিমপাড়া ইয়াসমিন খাতুনের উঠোনে বসে কথা হয় তার সাথে। ১৯৯৬ সালে স্বামীহারা হয়ে শিশু সন্তান নাঈমকে নিয়ে বাবা জহের আলীর বাড়ীতে ফেরেন।
ভাই-ভাবীর সংসারে সমস্যা দেখা দিলে টেইলারিং এর কাজ শুরু করেন। ৯৮ সালে দজির্র কাজ করে জমানো টাকা দিয়ে ৬ শতক জমি কিনে পৃথক একটা বাড়ী করেন। ৪ বছর পরে ঢাকায় চলে যান। কুড়িলে টেইলারিং কাজ শিখতে শুরু করেন। ২ বছর পরে কাজটা ভালো করে শিখে বাড়ী ফেরেন।

২০০৫ সালে একটা সেলাই মেশিন কিনে টেইলারিং এর কাজ শুরু করেন। বাড়ীবাড়ী গিয়ে জামা-কাপড়ের অর্ডার নিয়ে এসে কাজ করেন। এ সময়ই তার এলাকায় তার মতো নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণের চিন্তা মাথায় আসে। আমার মতোই তারা যেন কারো বোঝা না হয়ে আত্মনিভর্র হতে পারে সে জন্যই আমি এ পর্যন্ত ৪৫০ নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহায়তা করেছি।

এরপরও থেমে থাকেননি। বলেন, ভাবলাম প্রশিক্ষণ দেওয়া নারীদের নিয়ে একটা ফ্যাশন হাউজ করলে কেমন হয়। করে ফেললেন, ছেলের নামে নাঈম ফ্যাশন এন্ড টেইলারিং হাউজ। সঙ্গে ছেলের কাপড়ের দোকান। সে দোকানের কাপড় কিনেই শুরু হলো যাত্রা। সেই ফ্যাশন হাউজে এখন ১৩ টা সেলাই মেশিন। আর ২০ জন তার মতো নারী এখানে হাতের এপলিক ডিজাইন করার চাকরি করছেন এখন।

নুরুন্নাহার আরো জানালেন, জয়গুন নামে একজন দক্ষ প্রশিক্ষক দিয়ে গ্রামে গ্রামে নারীদের সেলাই শেখাতে উঠোন প্রশিক্ষণ কর্মসূচী শুরু করেছেন নামমাত্র অর্থে ১০ টাকার বিনিময়ে। বলেন, ‘সারা পেয়েছি কিন্তু মেশিন সংকটে উঠোন কর্মসূচী সম্প্রসারণ করতে পারছি না।

ফ্যাশন হাউজের কাজ সম্পর্কে নূরুন্নাহার জানান, মূলতঃ নারী ও শিশুদের পোষাক বানানো হয়। তাতে বিভিন্ন রংয়ের কাপড় শৈল্পিকভাবে হাতে এপলিক করে ডিজাইন করা হয়। আশপাশের উপজেলা সদরের গার্মেন্টস্ দোকানগুলোতে তার ছেলে নাঈম (২৪) গিয়ে অর্ডার মতো সরবরাহ করেন।

তিনি জানান, ৮৬তে বাল্যবিয়ে হয়েছিলো। তখন পঞ্চম শ্রেণিতে। স্বামীর সংসার করেও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। নূরুন্নাহার আরো স্বপ্ন দেখেন। বলেন, ‘১০০ নারীর কর্মসংস্থান করতে চাই। ৫০ টা মেশিন কিনতে চাই। এ্যামব্রয়ডারি, বস্নক, বাটিক এর কাজ করতে চাই। আর আমার কাজ ঢাকায় বাজারজাত করতে চাই। চাই সরকারী সহযোগিতা, সহজ শর্তে ঋন।’ গৃহবধু ইয়াসমিন খাতুন জানান, কাজ শেখা প্রায় শেষ। এখন নাহার আপার অর্ডারী কাজ করতিচি। রোজগার করতিচি। সে আমাগারে উপায়ের পথ দেখাইচে।

সারমিন খাতুন জানান, কাজটা শিখতিচি। নিজির পায়ে দাঁড়াবের চাই। সংসারে বাড়তি আয় দরকার। কাজটা খুব ভালো। উর্মি খাতুন জানান, মেয়েরা এখন অনেক কাজ করে সংসার করেও। তাতে সংসারে অভাব থাকে না। ছেলে-মেয়ে মানুষ করা সহজ হয়।

উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা চিত্রা রানী সাহা জানান, নূরুন্নাহার একজন সংগ্রামী ও ত্যাগী নারীর মডেল। সে একা সংগ্রাম করছে। আবার তার সাফল্য সমাজের অন্য নারীদের পথ দেখাচ্ছে। তাকে আমি স্যালুট করি।

মথুরাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার আজিজুল হক জানান, তিনি আমাদের এলাকার গর্ব। অনেক নারীদের জীবিকার পথ দেখিয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জানান, সত্যিই নুরুন্নাহার আলো ছড়াচ্ছে। তার জীবন সংগ্রাম অনন্য সাধারণ। জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ-এ গত বছর তাকে আমরা শ্রেষ্ঠ জয়িতা হিসাবে সম্মাননা দিয়েছি।



মন্তব্য চালু নেই