চলমান সংকট; আলোচনা চান তারানকো

চলমান সংকট নিয়ে বাংলাদেশ সরকার এবং অন্য পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে চান জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। এ জন্য তিনি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি একে আবদুল মোমেনের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন তিনি। তবে সরকারের অনুমতি না থাকায় এখনই তারানকোকে সাক্ষাতের সময় দিচ্ছেন না মোমেন।

জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের চলমান সংকট নিরসনে সরকার ও বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে লিয়াজোঁ করার জন্য তারানকোকে দায়িত্ব দেন। আর্জেন্টিনার কূটনীতিক তারানকো গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ সফর করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তখন তিনি সফল হননি।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জাতিসংঘের উদ্যোগের ব্যাপারে সরকারের সম্মতির কোনো লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না। জাতিসংঘ একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থা হওয়ায় সরকারের সম্মতি ছাড়া এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে কঠিন। এ পরিস্থিতিতে তাই তারানকো সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। বিষয়টি সম্পর্কে জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি আবদুল মোমেন টেলিফোনে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় রাজি হবে বলে মনে হয় না। নির্বাচনের আগে এবং এখনকার প্রেক্ষাপট এক নয়। বর্তমানে সাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় আছে। তাছাড়া সন্ত্রাসকে জাতিসংঘও পছন্দ করে না।’ তবে বিষয়টি সম্পর্কে অন্য একজন অভিজ্ঞ কূটনীতিক যুগান্তরকে বলেন, ‘জাতিসংঘ কোনো বিষয়ে উদ্যোগ নিলে তাকে সরাসরি না বলা সরকারের জন্য কঠিন। ফলে এ মুহূর্তে সরকার রাজি না হলেও শেষ পর্যন্ত কী হয় তা এখনই বলা যায় না।’

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, তারানকো নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ সফরে আসার সময় জাতিসংঘের রাজনীতিসংক্রান্ত বিভাগের সহকারী মহাসচিব ছিলেন। বর্তমানে তিনি এই বিশ্ব সংস্থার শান্তি প্রতিষ্ঠাবিষয়ক বিভাগের প্রধান। ফলে রাজনীতির বিষয়টি তার দেখার কথা নয়। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের হাইকমান্ডসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে প্রচুর ই-মেইল, চিঠি, টেলিফোন এবং ফ্যাক্সের মাধ্যমে তারানকোকে সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। তারানকো নিজেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের বিষয়ে অবহিত। এ কারণে তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে মহাসচিব বান কি মুনের কাছে বাংলাদেশের সংকট নিয়ে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করলে জাতিসংঘ মহাসচিব তাকে দায়িত্ব দেন।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বান কি মুন আন্তরিকভাবে চান রাজনৈতিক অস্থিরতায় যাতে দেশের উন্নতি ব্যাহত না হয়। এ কারণেই বাংলাদেশের প্রতি তার ব্যক্তিগত অঙ্গীকার থেকেই বর্তমান সংকটের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তিতে আগ্রহী হয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের উপমুখপাত্র ফারহান হকের কাছে বার্তা সংস্থা ইউএনবি জানতে চেয়েছিল, তারানকো সংলাপের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও বিএপির মধ্যে সমঝোতা করতে বাংলাদেশে আসবে কিনা। জবাবে ফারহান বলেছেন, ‘এখন আমাদের নতুন কোনো মন্তব্য নেই।’

এদিকে, কূটনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার উদ্যোগ নিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কৌশল প্রণয়নের জন্য ব্রাসেলসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ইসমত জাহানকে ঢাকায় ডেকে আনা হয়েছে। উল্লেখ্য, ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দফতর অবস্থিত। ইসমত জাহান ইতিপূর্বে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্বও পালন করেছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ইতিপূর্বে জেনেভা থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সেখানে সংঘাতের কথা বলায় তার প্রতিবাদ করেছে সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য হল- সংঘাত হয়ে থাকে দু’পক্ষের মধ্যে। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, সেটা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট একতরফাভাবে সাধারণ মানুষের ওপর পেট্রলবোমা হামলা পরিচালনা করছে। ফলে এটা সংঘাত নয়, সহিংসতা।

ঢাকায় বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা চলমান সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ অব্যাহত রেখেছেন। কানাডার হাইকমিশনার বেনওয়া পিয়ের লাঘামে রোববার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ এবং দেশের জন্য এক ভয়াবহ প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। এটা সত্যিকার অর্থেই অগ্রহণযোগ্য। ঢাকায় কানাডার বাণিজ্য মেলা আয়োজন উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলন হয়েছিল। তিনি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত সবাই তাদের বিনিয়োগের জন্য স্থিতিশীলতা ও শান্তি পছন্দ করেন। বাংলাদেশে কানাডার বিনিয়োগের জন্যও এটা একটা শর্ত। কানাডার হাইকমিশনার বলেন, ‘ভিকটিমদের দুর্ভোগ দেখে আমি শোকাহত। এই ভিকটিমরা অবশ্যই সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন। অবশ্যই এ সহিংসতার অবসান হতে হবে এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক স্পেস অবশ্যই সৃষ্টি করতে হবে।’

এদিকে চীনের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মা মিঙ্গকিয়াঙ্গ রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, শিগগিরই চলমান পরিস্থিতির অবসান হবে এবং দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী চীনের রাষ্ট্রদূতকে চলমান অবরোধ এবং সহিংসতা ও পেট্রলবোমা হামলার কথা অবহিত করেন। মন্ত্রী বলেন, এটা গণতন্ত্রের ভাষা হওয়া উচিত নয়। জবাবে চীনের রাষ্ট্রদূত নিরীহ মানুষ এ সহিংসতার টার্গেট হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং ভিকটিমদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে শান্তি ও নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন দেখতে চায় চীন।



মন্তব্য চালু নেই