চরাঞ্চলে অপরিণত বয়সে বিয়ে: চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মা-শিশু

মোঃ ফজলে আলম, ভোলা থেকে: ভোলার চরাঞ্চলগুলোতে অধিকাংশ পরিবারে নিত্য অভাব-অনটন লেগেই আছে। আর্থিক টানাপোড়েনের শিকার এসব দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে এখানকার অমোঘ নিয়ম।

চরাঞ্চলগুলোতে মেয়েদের সাধারণ ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যেই বিয়ে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে অনেকটাই দায়মুক্ত হতে চান বাবা-মা। ফলে অপরিণত বয়সের এ বিয়ের কারণে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভোগেন এ অঞ্চলের বাসিন্দারা, বিশেষ করে অল্প বয়সে বিয়ে ও গর্ভধারণের কারণে নারীরা ব্যাপকহারে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন। মায়ের কারণে অপুষ্টি, বিকলাঙ্গতাসহ নানা সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে চরাঞ্চলের শিশুদের।
এমনকি, বাল্যবিয়ের কারণে বিচ্ছেদ ও মৃত্যুও এখন হরহামেশাই ঘটছে ভোলার বিভিন্ন চরগুলোতে। সংসারেও দেখা দিচ্ছে নানান সমস্যা।

ভোলা সদর উপজেলার মাঝের চরের বাসিন্দা আছমা (১৬)। ৫ বছর আগে মাত্র ১১ বছর বয়সে বিয়ে হয় একই গ্রামের ২৪ বছর বয়সী আলমগীর হোসেনের সঙ্গে। আড়াই বছরের একটি ছেলে রয়েছে তার। তবে ছেলেটি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ভুগছে।

আছমা বলেন, ‘যহন সবাই স্কুলে যায় হেই সময় আমি স্বামীর সংসারে গেছি। মোনে চাইতো পড়ালেহা করুম, কিন্তু বাপ-মায় বিয়া দিয়া দিলো। স্বামীর সংসারে প্রতিদিন অনেক কাম করি, তারপরও শান্তি নাই। উঠতে-বসতে অপয়া-অলক্ষ্মী কথা শুনতে হয়। ছেলেটা জন্ম পর থেকে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। এর জন্য আমাকে দায়ী করে। কই যামু, যাওয়ার কোনো পথ নাই।’

স্থানীয় আরেক গৃহবধূ জোসনা আক্তারের বিয়ে হয় ১২ বছর বয়সে। বিয়ের কিছুদিন পর স্বামী আরেকটি বিয়ে করে তাকে তালাক দিয়েছেন। একমাত্র সন্তান নিয়ে স্বামীর সংসার থেকেও বিতাড়িত হয়েছেন তিনি। তাই বাধ্য হয়ে বাড়ি-বাড়ি ঝিয়ের কাজ করতে হচ্ছে তাকে। এমনকি, ছোট্ট ছেলেটার অসুখ-বিসুখে ডাক্তার দেখানোর মতোও সামর্থ্য নেই তার।

চরের মানুষকে নিয়ে কাজ করা ইউনিসেফ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন জানা যায়।

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ের ও একই বয়সের ৫ শতাংশ ছেলের বিয়ে হয়। এছাড়া দেশের ১০-১৯ বছর বয়সের দুই-তৃতীয়াংশ মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৩৯ শতাংশ ও ১৮ বছরের মধ্যে ৭৪ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়। ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের এই হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। যেখানে প্রতিবেশী দেশ ভারতে বাল্যবিয়ের গড় হার ৫০ শতাংশ, নেপালে ৫৭ শতাংশ এবং আফগানিস্তানে ৫৪ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিত মেয়েদের ২০ শতাংশ ২৪ বছর বয়সের আগেই দুই বা ততোধিক সন্তানের মা হন। ফলে দেশে প্রসূতি মৃত্যুর হার ও অপুষ্টিজনিত সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এসব বিষয়ে ভোলা সদর হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. সুরাইয়া ইয়াসনুর বলেন, একজন পূর্ণবয়স্ক মায়ের চেয়ে অপরিণত বয়সে মা হওয়ায় প্রসবকালীন ঝুঁকি দ্বিগুণ থাকে। ১৮ বছরের কম বয়সে অন্তঃসত্ত্বা হলে গর্ভপাতসহ প্রসবকালীন মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে সবচেয়ে বেশি।

তিনি বলেন, কমবয়সে গর্ভধারণ করায় প্রসূতির শরীর ভেঙে যায়। নিজেকে বোঝার মতো উপলদ্ধির আগেই মেয়েরা দুই থেকে তিন বাচ্চার মা হওয়ার ফলে তাদের মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। তাই এসব মায়েদের জন্ম দেওয়া সন্তান অনেকক্ষেত্রেই মানসিক ও শারীরিক সমস্যা নিয়ে জন্ম নেয়।

তিনি আরো বলেন, অপরিণত বয়সে মা হওয়ার ফলে মায়েদের জরায়ু ক্যান্সারও হতে পারে। তাই কিশোরীদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। এছাড়া বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একত্রিত হয়ে গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা বলেন, বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের সর্বোত্তম ব্যবহার ও আমাদের সচেতনতাই পারে বাল্যবিয়ে হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে।



মন্তব্য চালু নেই