চট্টগ্রামের নগরপিতা নাছির

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন।

মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে চসিকের ৭১৯টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে সবকয়টির বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা করেন চট্টগ্রামের বিটার্নিং অফিসার আবদুল বাতেন। এতে দেখা গেছে, আ জ ম নাছির উদ্দিন হাতি মার্কায় ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬১ ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলম কমলালেবু প্রতীকে পেয়েছেন ৩ লাখ ৪ হাজার ৮৩৭ ভোট।

চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়ামে অবস্থিত নির্বাচন কমিশনের অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ঘোষিত বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী আ জ ম নাছির উদ্দিন নিকটতম প্রতিপক্ষের চেয়ে ১ লাখ ৭০ হাজার ৫২৪ ভোট বেশি পেয়েছেন।

অবশ্য মঙ্গলবার দুপুরের আগেই নির্বাচনে কারচুপি আর কেন্দ্র দখলের অভিযোগ এনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলম নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেন। এতে আ জ ম নাছিরের বিজয় শতভাগ নিশ্চিত ধরে নেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা।

আ জ ম নাছির উদ্দিনের বিজয় নিশ্চিত জেনে মঙ্গলবার রাতেই নগরীর বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা যায়।

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক এবং প্রাক্তন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ রাতে বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত ভোটে আ জ ম নাছির নগরপিতার আসনে বসতে যাচ্ছেন। সমগ্র চট্টগ্রামে শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণের পর আ জ ম নাছিরের পক্ষেই গণরায় এসেছে বলে ঘোষিত ফলাফলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিএনপি প্রার্থী মনজুর আলম ভোট শুরু হতে না হতেই নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপেচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি। বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। আ জ ম নাছির মেয়র হলে চট্টগ্রামের ব্যাপক উন্নয়ন অগ্রগতি সাধিত হবে।’

আ জ ম নাছিরের রাজনৈতিক গুরু ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপির নির্বাচন বর্জনের কারণে এটা নিশ্চিত যে আ জ ম নাছিরই হচ্ছেন চট্টগ্রাম নগরীর পরবর্তী মেয়র। চট্টগ্রামবাসী পরিবর্তন চেয়েছে। তাই আ জ ম নাছিরের মতো একজন উদ্যমী তরুণ চট্টগ্রামের নগরপিতা হতে যাচ্ছেন। আ জ ম নাছির চট্টগ্রামের জন্য অনেক অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।’

এদিকে ভোটের ফলাফল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় বিএনপির সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল নোমান বলেছেন, ‘এটা কোনো নির্বাচনই হয়নি। সব ভোটকেন্দ্র দখল করে নিয়ে প্রহসনের নির্বাচনে কী ফলাফল হলো তাতে কিছু আসে-যায় না। এই নির্বাচনে কোনো সাধারণ ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। তাই আমরা এই নির্বাচন বয়কট ও প্রত্যাখ্যান করেছি।’

আ জ ম নাছিরের জীবনবৃত্তান্ত
আ জ ম নাছির উদ্দিন ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামের সরকারি মুসলিম হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও ডিগ্রি পাশ করেন।

স্কুলজীবন থেকেই আ জ ম নাছির ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত হন। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে স্কুলছাত্র হিসেবে মিছিলে যোগ দেন তিনি। ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি, একই সঙ্গে নগর ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান নাছির। পর্যায়ক্রমে ১৯৮০ এবং ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। ১৯৮৩ এবং ১৯৮৫ সালে হন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি। পর পর দুই বার চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আ জ ম নাছির উদ্দিনকে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত করেন। এর পর থেকে তিনি আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে সর্বাত্মক সচেষ্ট রয়েছেন। চট্টগ্রামের ক্রীড়া ও রাজনীতির অঙ্গন জয় করে তিনি এখন দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে নগরপিতা হিসেবে চট্টগ্রাম নগরবাসীর সেবা করতে চান।

আ জ ম নাছির উদ্দিন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান। তার প্রপিতামহ মরহুম মাওলানা মোহাম্মদ হোসেন। তিনি ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে হাদিস শরিফের ওপর মোহাদ্দেস ডিগ্রি লাভ করেন। চট্টগ্রামের প্রথম এবং সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী মোহাদ্দেস ছিলেন তিনি। চট্টগ্রাম সরকারি ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজ (সাবেক আইআই কলেজ) বর্তমান সরকারি মহসিন কলেজের অধ্যক্ষও ছিলেন মাওলানা মোহাম্মদ হোসেন। এ ছাড়া তিনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের অবৈতনিক পেশ ইমাম এবং খতিব ছিলেন।

আ জ ম নাছিরের প্রপিতামহের আদি নিবাস ফটিকছড়ি উপজেলার লেলাং ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামে। তার পিতা ছিলেন স্বনামধন্য জমিদার মরহুম মৌলভী আকবর আলী চৌধুরী। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মোহাদ্দেস সাহেব গ্রামের বাড়ি থেকে এসে চট্টগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু আন্দরকিল্লা নজির আহমদ চৌধুরী সড়কে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তার সুযোগ্য ছেলে মোহাম্মদ হোসেন মোহাদ্দেসের যশখ্যাতির কারণে বাসস্থানটি ‘মোহাদ্দেস সাহেবের বাড়ি’ নামে খ্যাতি লাভ করে।

মোহাদ্দেস সাহেবের সুযোগ্য ছেলে মরহুম হাফেজ আবু মোহাম্মদ শামসুদ্দিন। আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতম তারাবির ইতিহাসে যে নামটি আজও মুসল্লি তথা চট্টগ্রামবাসীর স্মৃতিতে অনন্য, তিনি হাফেজ আবু মোহাম্মদ শামসুদ্দিন (প্রকাশ হাফেজ আবু)। তার বড় ছেলে মরহুম সৈয়দ মঈনুদ্দিন হোসেন। সৈয়দ মঈনুদ্দিন ছিলেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সমাজসেবক, প্রখ্যাত ক্রীড়া সংগঠক, চট্টগ্রাম মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সহসভাপতি। তিনি মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত মোহাম্মদ হোসাইন মোহাদ্দেস ওয়াক্‌ফ এস্টেটের মোতোয়াল্লি ছিলেন। মরহুম সৈয়দ মঈনুদ্দিন হোসেনের ছয় ছেলে ও তিন মেয়ে। সৈয়দ মঈনুদ্দিন হোসেনের চতুর্থ ছেলে আ জ ম নাছির উদ্দিন।

আ জ ম নাছির উদ্দীনের মা ফাতেমা জোহরা বেগম। চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ইয়াসিন নগরের হলদিয়ায় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মরহুম আলহাজ বদিউল আলম ও আছিয়া খাতুনের মেজো মেয়ে তিনি। পিতৃহারা ছেলে-মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব পালন করেন এই মহীয়সী নারী। রত্নগর্ভা ধার্মিক এই নারীর সুযোগ্য সন্তান আ জ ম নাছির উদ্দিন।



মন্তব্য চালু নেই