গ্যাস উৎপাদনে লোকসানে নেই প্রতিষ্ঠান, তবুও দাম বাড়ছে

গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির সপক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান সমন্বয়ের কথা। তবে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গ্যাস উৎপাদনে লোকসানে নেই এসব প্রতিষ্ঠান। দেশের বিভিন্ন কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স), বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল)। কয়েক বছর ধরেই মুনাফার ধারায় রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান।

কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে মুনাফা করছে এসজিএফএল। গত অর্থবছর (২০১৫-১৬) প্রতিষ্ঠানটির সব ধরনের কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছিল ৩৩৪ কোটি টাকা। আগের অর্থবছর (২০১৪-১৫) প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা হয়েছিল ৩৯৯ কোটি ও ২০১৩-১৪ অর্থবছর ৪৭৬ কোটি টাকা।

সিলেট গ্যাস ফিল্ডসের পাশাপাশি বাপেক্সও ২০১৪-১৫ অর্থবছর ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা মুনাফা করেছিল। কিন্তু গত অর্থবছর অনুৎপাদনশীল খাতে ওয়ার্কওভার ঋণের সুদ বহন করতে গিয়ে ৫৮ কোটি টাকা লোকসানের সম্মুখীন হয় কোম্পানিটি। যদিও আগের বছরগুলোয় মুনাফার ধারায়ই ছিল বাপেক্স।

অন্যদিকে বিজিএফসিএল গত অর্থবছর ৩১ কোটি টাকা লোকসান দিলেও আগের বছরগুলোয় ছিল মুনাফার ধারায়। প্রতিষ্ঠানটির আয়-ব্যয়ের হিসাব ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছর ১৫৬ কোটি ৯৯ লাখ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছর ৪৪৭ কোটি ১০ লাখ টাকা মুনাফা করে প্রতিষ্ঠানটি।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ও পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, গ্যাস উৎপাদনে কোনো কোম্পানিকেই লোকসান দিতে হচ্ছে না। গত অর্থবছর দুটি প্রতিষ্ঠান লোকসান দিলেও তার কারণ ছিল অলাভজনক খাতে বিনিয়োগ, সম্পদের অপচয় ও জাতীয় বেতন কাঠামো।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১২-১৪ সালের মধ্যে বিজিএফসিএল, এসজিএফএল ও বাপেক্সের মালিকানাধীন বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রে ১০টি উন্নয়ন কূপ খনন করে গ্যাজপ্রম। এসব কূপ খননের জন্য বাপেক্স আগ্রহ দেখালেও প্রায় তিন গুণ বেশি ব্যয়ে গ্যাজপ্রমকে কাজ দেয় মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে কারিগরি বিভিন্ন ত্রুটির কারণে এসব কূপের পাঁচটিই দুই বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। পরে এসব ব্যর্থ কূপে ওয়ার্কওভার কাজ করার জন্য বাপেক্সকে নির্দেশনা দেয় মন্ত্রণালয়। আর এজন্য গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণ নিতে বলা হয়। এ ধরনের অনুৎপাদনশীল ক্ষেত্রে কাজ করায় বাপেক্সের ব্যয় ও ঋণ দুটোই বেড়ে যায়।

এছাড়া বিজিএফসিএলের সম্পদের অপচয়সহ অন্যান্য ব্যয় বাড়ার কারণে গত অর্থবছর লোকসান হয়েছে। কিন্তু এ লোকসানের সঙ্গে গ্যাস উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

নতুন মূল্যহার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রায় সবক’টি প্রতিষ্ঠানের গ্যাস উৎপাদন ব্যয় তথা ওয়েলহেড মার্জিন সাড়ে ২২ পয়সা। অথচ গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের গড় মূল্য ৭ টাকা ৮৩ পয়সা। এ অর্থের সিংহভাগ তথা ৫৫ শতাংশ বেড়েছে সম্পূরক শুল্ক ও মূসক যোগ করার কারণে, যার পুরো টাকা গত বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত পেট্রোবাংলার কোষাগারে জমা হয়েছে। এছাড়া গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দামের মধ্য থেকে তুলে নেয়া হয় ট্রান্সমিশন চার্জ, বিতরণ চার্জ, গ্যাস উন্নয়ন তহবিল চার্জ ইত্যাদি। এছাড়া সম্প্রতি গঠিত জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলের টাকাও সংগ্রহ করা হয় এখান থেকেই। ফলে গ্যাস উৎপাদনে কোনো কোম্পানির লোকসান হওয়ার কোনো সুযোগই নেই।

সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষ বলছে, আইওসি গ্যাসের ব্যয় বেশি থাকায় তা পোষাতে হয় ভর্তুকি দিয়ে। কিন্তু তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে গ্যাস উৎপাদনকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে (আইওসি) প্রতি ঘনমিটার গ্যাস কিনতে হয় প্রায় ৩ টাকা ১০ পয়সায়, যেখান থেকে পেট্রোবাংলার প্রাপ্য অংশ ১ টাকা ৬ পয়সা। এর বিপরীতে ঘাটতি থেকে যায় প্রায় ২ টাকা ৩ পয়সা। কিন্তু দেশীয় তিনটি কোম্পানির উৎপাদিত গ্যাস ও আইওসি গ্যাসের ওপর আরোপিত সম্পূরক শুল্ক ও মূসকসহ অন্যান্য চার্জ যোগ করে তা বিক্রি হয় প্রতি ঘনমিটার গড়ে ৬ টাকা ৩৮ পয়সায়। ফলে আইওসি থেকে যেটুকু বেশি দামে কেনা হয়, গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা আদায়ের পর তা মিটিয়েও বিপুল পরিমাণ অর্থ পেট্রোবাংলার কাছে জমা থাকে। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরও পেট্রোবাংলার কাছে জমা হবে ২ হাজার ৬০১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

দেশের অভ্যন্তরে গ্যাস উৎপাদনে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক কোম্পানি (আইওসি) রয়েছে তিনটি— অস্ট্রেলিয়ার সান্তোস, যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন ও যুক্তরাজ্যের তাল্লো। এসব কোম্পানির কাছ থেকে বেশি দামে গ্যাস কিনে গ্রাহক পর্যায়ে কম দামে বিক্রি করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবি আর) ১৯৯৮ সালে জারি করা ২২৭ নং এসআরও অনুযায়ী, আইওসি গ্যাস শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত। কিন্তু এত বছর ধরে এর ওপর সম্পূরক শুল্ক ও মূসক বাবদ যে অর্থ পাওয়া গেছে, এনবি আরকে না দিয়ে নিজের কোষাগারে জমা রাখে পেট্রোবাংলা। এদিকে গত বছরের শুরুতে এনবি আর ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত পেট্রোবাংলার কাছে সম্পূরক শুল্ক ও মূসক বাবদ পাওনা ১৯ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা দাবি করে।

এর মধ্যে ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইওসির কাছ থেকে কেনা গ্যাসের বিক্রয় মূল্যের ওপর ৫৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও মূসক বাবদ ৩ হাজার ৮১ কোটি ১৫ লাখ টাকা বকেয়া পরিশোধ করে পেট্রোবাংলা। পাশাপাশি একই বছরের ডিসেম্বর থেকে গত অর্থবছরের শেষ দিন পর্যন্ত আরো ৩ হাজার ৮০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।

এনবি আরের কাছ থেকে এ অর্থ রেয়াত না পেলে পেট্রোবাংলার সংকটে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণে নতুন মূল্যহারে ‘সাপোর্ট ফর শর্টফল’ নামে নতুন একটি চার্জ চালু করা হয়েছে, যেখান থেকে আওসি ও দেশী কোম্পানি লোকসানে পড়লে প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা দেয়া হবে। নতুন এ চার্জ থেকে পেট্রোবাংলার প্রতি বছর বাড়তি আয় হবে প্রায় ২ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, গ্যাস একটি সেবা খাত। আর সব সেবা খাতই এসডি ভ্যাটমুক্ত। কিন্তু সরকার গ্যাস থেকে ৫৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও মূসক নিচ্ছে, যেটা যৌক্তিক নয়। পাশাপাশি গ্যাস বিক্রির টাকা বিভিন্ন খাতে বণ্টন বন্ধ করা গেলে কোম্পানিগুলোর ব্যয় আরো কমবে। তখন গ্যাসের মূল্যহার বাড়ানোর দরকারও হবে না, বরং কমে যাবে। সুত্র : বনিক বার্তা



মন্তব্য চালু নেই