গুলশান হামলা, ৩ যুবককে খুঁজছে পুলিশ

ঘড়ির কাঁটায় ১ জুলাই রাত ৮টা ৪২ মিনিট। টেনিস র‍্যাকেটের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে পাঁচ জঙ্গি গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কে হলি আর্টিজান বেকারি নামের রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ে। এরপর ৮টা ৪৭ মিনিটে জঙ্গিরা রেস্তোরাঁটি থেকে প্রথম একটি গ্রেনেড ছোড়ে। ঠিক ওই সময় তিন যুবক ৭৯ নম্বর সড়ক ও পাশের ৭৮ নম্বর সড়কে ঘোরাফেরা করছিলেন।

ওই রেস্তোরাঁর আশপাশের সড়কের একাধিক ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ১ জুলাই রাতের ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এ দৃশ্য দেখা গেছে বলে জানিয়েছে মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশ এখন ওই তিন সন্দেহভাজন যুবককে খুঁজছে। ফুটেজে দেখা যায়, ওই তিনজনের পরনে ছিল প্যান্ট-শার্ট। তাঁরা ইউনাইটেড হাসপাতালের দিকে যাওয়ার একপর্যায়ে উধাও হয়ে যান।

পুলিশের ধারণা, ওই তিন যুবক হামলাকারীদের সহযোগী ছিলেন। তাঁরা হয়তো বাইরে থেকে পুরো ঘটনাটি তদারক করছিলেন।

তদন্তকারী সূত্র বলেছে, রেস্তোরাঁটি থেকে জব্দ করা ৭৪টি আলামত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক পরীক্ষাগারে পাঠানোর জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে। এসব আলামতের মধ্যে রয়েছে পিস্তল, একে-২২ সেমি অটোমেটিক রাইফেল, এই রাইফেলের ও পিস্তলের ম্যাগাজিন, গুলি, ছুরি, চাকু, চাপাতি, ছোরা, মুঠোফোন, গ্রেনেডের সেফটি পিন। এ ছাড়া নিহত জঙ্গিদের রক্তের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করা হবে। আদালতের অনুমতি পাওয়ার পর এসব আলামত পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে।

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের (সিটি) ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর আশপাশের এলাকা থেকে অর্ধশত সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া পুরো গুলশান এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ করে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সন্দেহভাজন ওই তিনজন কোন পথ দিয়ে বেরিয়ে গেছেন, সেটি ফুটেজ দেখে নির্ণয়ের চেষ্টা চলছে। এই তিনজনকে পাওয়া গেলে তদন্তসংক্রান্ত নতুন তথ্য পাওয়া যাবে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, গুলশানের অধিকাংশ সড়কের মোড়ে সিসি ক্যামেরা নেই। এ কারণে জঙ্গিরা কোন পথ দিয়ে গুলশানে ঢুকেছে তার ছক মেলাতে পারছেন না তাঁরা। ফুটেজে দেখা যায়, দুই জঙ্গির পেছনে আরও তিন জঙ্গি হেঁটে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ঢুকছে। রেস্তোরাঁটিতে লাগানো সিসি ক্যামেরাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেগুলোর কোনো ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায়নি। তবে আশপাশের ভবন থেকে ধারণ করা ফুটেজে দেখা যায় জিম্মি হাসনাত করিমের হাতে অস্ত্র। অবশ্য হাসনাত জিজ্ঞাসাবাদে দাবি করেছেন, জঙ্গিরা তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়ায় তিনি অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

তদন্তকারীরা বলেন, হাসনাতকে তাঁরা সন্দেহভাজন হিসেবে দেখছেন। তাঁর কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন হাসনাত করিম। তাঁকে সেখান থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং জঙ্গি হামলায় তাঁর সম্পৃক্ততা আছে কি না, সে বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।

পুলিশ হাসনাত করিম ও জিম্মি অবস্থা থেকে উদ্ধার করা ব্যবসায়ীপুত্র তাহমিদ হাসিবকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়ার দাবি করলেও নির্ভরযোগ্য সূত্র বলেছে, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কার্যালয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল।

এদিকে হাসনাত করিমের পারিবারিক সূত্র বলেছে, উদ্ধারের পর ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হাসনাতকে গত শুক্রবার ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করলেও তিনি গতকালও বাসায় ফেরেননি। গতকাল সকালে তাঁর মা হোসনে আরা করিম ও চাচা আনোয়ারুল করিম ডিবি কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে বলা হয়, দেখা করা যাবে না। এ সময় ডিবি তাঁদের বলেছে, হাসনাত করিম তাদের হেফাজতে আছে। পরিবারের পক্ষ থেকে গতকাল ডিএমপি কমিশনারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে বলা হয়, হাসনাত শারীরিকভাবে অসুস্থ। স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে যেন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁর দ্রুত মুক্তির আবেদন জানিয়ে আবেদনে আরও বলা হয়, তাঁরা সরকারকে সব ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, অভিযানের সময় পাঁচ জঙ্গি ছাড়াও রেস্তোরাঁর কর্মী সাইফুল চৌকিদার নিহত হন। নিহত হওয়ার আগে সাইফুল জঙ্গিদের সহায়তা করছিলেন—ভিডিও ফুটেজে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। তাঁর সঙ্গে জঙ্গিদের কোনো যোগাযোগ ছিল কি না, তা তাঁর মুঠোফোনের কল তালিকা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। জঙ্গিরা রেস্তোরাঁয় মুঠোফোন নেয়নি। তারা জিম্মিদের মুঠোফোন ব্যবহার করে কথা বলার কারণে তাদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি মারা গেলেও তাদের পেছনের ব্যক্তি কারা, সেটি খোঁজা হচ্ছে।

কাউন্টার টেররিজম বিভাগের আরেক কর্মকর্তা দাবি করেন, তাঁদের কাছে হামলাকারী জঙ্গিদের সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। তা ধরে তদন্ত চলছে।

১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হানা দেয় জঙ্গিরা। ওই রাতে অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা রবিউল করিম ও সালাউদ্দিন খান। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের নেতৃত্বে সমন্বিত অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়। সেখান থেকে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জিম্মির লাশ উদ্ধার করা হয়। অভিযানের আগে-পরে উদ্ধার করা হয় দেশি-বিদেশি ৩২ জনকে। -প্রথম আলো



মন্তব্য চালু নেই