গুলশান হামলা, ৩ মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে চলছে তদন্ত

মোবাইল ফোনে কলের সূত্র ধরে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে হামলার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। ১ জুলাই ওই হামলার পর জঙ্গিরা তিনটি মোবাইল নম্বরে কয়েকবার কথা বলে। সন্দেহভাজন ওই নম্বরগুলোর দুটি দেশের বাইরের। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, হামলাকারীরা ঘটনার রাতে কাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করেছেন তা নিশ্চিত হওয়া গেলেই তদন্ত অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

কয়েক দিনে প্রত্যক্ষদর্শীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তদন্তকারী সংস্থা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এর মধ্যে কয়েকজন সাংবাদিকও রয়েছেন। গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। তারা বলেছেন, ঘটনার পর প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে দেখা হচ্ছে।

সন্দেহভাজন ৫ জনকে হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। এর মধ্যে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিম ছাড়াও দু’জনের নাম প্রকাশ করেছে পুলিশ। এরা হচ্ছেন- জাকিরুল ইসলাম ও নাজরুল সারেন।

ওই ঘটনায় সন্দেহভাজন জাকির হোসেন শাওনের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশি হেফাজতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার দুপুরে তার মৃত্যু হয়। শাওনের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। পুলিশ সন্দেহভাজন বললেও পরিবার দাবি করছে, শাওন হলি আর্টিজানের কর্মচারী। যখন শাওনকে আটক করা হয়, তখন তিনি সুস্থ ছিলেন। আটকের পর নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে।

হামলার পরদিন কমান্ডো অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’-এ নিহত পাঁচ জঙ্গির ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। শনিবার পর্যন্ত তাদের লাশ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) মর্গে রাখা ছিল।

গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরও শনিবার পর্যন্ত তাদের লাশ কেউ নিতে আসেনি। বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় নিহতদের স্বজনরা নানা বক্তব্য দিলেও পুলিশের কাছে লাশ নেয়ার ব্যাপারে কেউ আবেদন করেননি। ২৪ আগস্টের মধ্যে হলি আর্টিজানে হামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালত।

বুধবার পুলিশ ওই মামলার নথি আদালতে উপস্থাপনের পর মহানগর হাকিম স্নিগ্ধা রানী চক্রবর্তী ওই নির্দেশ দেন।

গুলশান হামলার তদন্তে প্রয়োজন হলে সিঙ্গাপুর, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। শনিবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের চৌকস পুলিশ অফিসার রয়েছে। তারাই গুলশান হামলা মামলা তদন্ত করবে। তবে তদন্তের স্বার্থে বা বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনে সিঙ্গাপুর, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নেয়া হবে।

গুলশানের ঘটনা বাংলাদেশে নতুন উল্লেখ করে পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘এর আগে বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটেনি। পুলিশের সাহসী ভূমিকার কারণে সেদিন হামলাকারীরা পালাতে পারেনি।’

এমন যুদ্ধাবস্থা পুলিশ এর আগে মোকাবেলা করেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পুলিশের নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। এ থেকে পুলিশ নতুন করে শিক্ষা নেবে।’ আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, শুধু পুলিশি কার্যক্রমে জঙ্গিবাদ দমন সম্ভব নয়। এজন্য জাতীয় ঐক্যও দরকার। যে যার স্থান থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলে জঙ্গিবাদ নির্মূল সম্ভব।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও জঙ্গি দমনে গঠিত কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, হলি আর্টিজানে হামলার পর জঙ্গিরা নির্দিষ্ট কয়েকটি নম্বরে একাধিকবার কথা বলেছে। ছবি আপলোড করেছে।

তিনি বলেন, যাদের সঙ্গে জঙ্গিরা কথা বলেছে তাদের পরিচয় জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিরা মোবাইল ফোনে অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে বাংলায় কথা বলেছে। এর থেকে তারা নিশ্চিত অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিরা বাংলাদেশী।

মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, হামলার পর মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে জঙ্গিরা অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে জিম্মিদের হত্যা করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। জঙ্গিরা এ সময় কয়েকটি বিদেশী নম্বরেও কল করে। এ সবই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

গুলশান হামলার তিন দিনের মাথায় বাংলাদেশে ফের হামলার হুমকি দিয়ে প্রকাশিত ভিডিও বার্তাটি নিয়েও তদন্ত করছে ডিবি। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মুখপাত্র বা দায়েশের বরাত দিয়ে ওই ভিডিওটি আপলোড করে বিতর্কিত সাইট ইনটেলিজেন্স গ্রুপ। ডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, গুলশানে জঙ্গি হামলার পর তারা কোনো কিছুকেই উড়িয়ে দিচ্ছেন না। সব কিছুকেই তদন্তের আওতায় নিচ্ছেন। ইতিমধ্যেই ওই তিন যুবকের পরিচয় মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

কয়েক মিনিটের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, তিন তরুণ বাংলা ও ইংরেজিতে কথা বলছে। এদের একজনের মুখ ঢাকা। গুলশানের হামলাকে এক ঝলক উল্লেখ করে বাংলা ও ইংরেজিতে এক তরুণ বলেন, এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে।

ভিডিওটিতে আরেক তরুণকে বলতে শোনা যায়, ‘শেখ আদনানির’ নির্দেশে তারা ‘খ্রিস্টান, ইহুদি ক্রসেডার ও তাদের মিত্রদের’ বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ করছে এবং এ যুদ্ধ কোনোভাবেই ‘কৌতুক’ নয়। ভিডিওতে তিন তরুণের বক্তব্যের আগে বাংলায় লেখা ভেসে ওঠে ‘বাংলায় খিলাফাহর বীরদের প্রতি’। আপলোডকারী সংস্থা দাবি করেছে, ভিডিওটি রাকা (ইউফ্রেতাস নদীর উত্তর তীরে গড়া সিরিয়ার একটি শহর, আইএসের ঘোষণা দেয়া সিরিয়ার রাজধানী) থেকে ধারণ করা হয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ভিডিওটি আপলোডের পর তারা ওই তিন তরুণের পরিচয় জানতে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিতে থাকেন। ভিডিওটির প্রথম তরুণের পরিচিত জন ও ফেসবুক বন্ধুদের কাছ থেকে গোয়েন্দারা জানতে পারেন সন্দেহভাজন ওই তরুণ বাংলাদেশে বেসরকারি এক মোবাইল ফোন কোম্পানিতে চাকরি করতেন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত সঙ্গীতবিষয়ক রিয়েলিটি শো ‘ক্লোজআপ ওয়ানের’ প্রথম দিকের সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ওই তরুণের। ক্লোজআপ ওয়ানে তার গাওয়া ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ গানটি সেই সময় শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে যায়।

ভিডিওর তৃতীয় তরুণের পরিচিতজন ও বন্ধুরা ফেসবুকে দাবি করছেন, ২০১৪ সাল থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। তিনি বিআইএস’র ইংরেজি ভার্সনের সাবেক ছাত্র। নিখোঁজ হওয়ার আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার নাম জুনুন শিকদার।

রাজধানীর গুলশান হামলার পর অন্তত ১০ তরুণের সন্ধান চেয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে যে আবেদন করা হয়েছে তার মধ্যে জুনুনের পরিবারও রয়েছে। তিনি ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন হত্যা মামলায় প্রধান সন্দেহভাজন বলে দাবি করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, ২০১৩ সালে পুলিশ তাকে ওই মামলায় গ্রেফতারও করে। পরে জামিন নিয়ে তিনি পালিয়ে যান।

১ জুলাই রাতে রাজধানীর কূটনৈতিক জোন গুলশানের ২ নম্বর সার্কেলের ৭৯ নম্বর সড়কে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে দুই পুলিশ সদস্য, ১৭ বিদেশী নাগরিক ও তিন বাংলাদেশী নিহত হন। পরে সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত কমান্ডো অভিযানে ছয় জঙ্গি নিহত হয় বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। ওই অভিযানে জীবিত উদ্ধার করা হয় তিন বিদেশী নাগরিকসহ ১৩ জিম্মিকে। -যুগান্তর



মন্তব্য চালু নেই