গিবতকারীর শাস্তি জাহান্নাম

গিবত বা পরনিন্দা মুমিনের আমলের জন্য মারাত্মক বিধ্বংসী এক রোগ। গিবতের ভয়াবহতা সম্পর্কে মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধারণার বশবর্তী হওয়া থেকে বেঁচে থাকো। নিশ্চয়ই কিছু ধারণা স্পষ্ট গুনাহ। আর কারো গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারো গিবত না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা সকলেই তো তা অপছন্দ করো। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, অত্যন্ত দয়ালু। (সুরা আল-হুজুরাত : ১২) আলোচ্য আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) একটি হাদিস উদ্ধৃত করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, আমি একদিন নবী করিম (স.)-কে দেখলাম, তিনি কাবা তাওয়াফ করার সময় বলছেন : তুমি কত সুন্দর! তোমার ঘ্রাণ কত সুন্দর! কত বড় তোমার মর্যাদা! আমি সেই মহান সত্ত্বার নামে শপথ করে বলছি, যার হাতে আমার প্রাণ। মুমিনের মর্যাদা নিশ্চয়ই তোমার চেয়ে অনেক বেশি। মুমিনের নিন্দা করা আর মুমিনের সম্পর্কে খারাপ ধারণা করার তো অবকাশই নেই। (তাফসিরে ইবনে কাসির : খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ৩৯২)

গিবতের সংজ্ঞা

আবদুল্লাহ ইবনে খোয়াইবিত আল-মাখজুমি বলেছেন, একবার এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসুল! গিবত কী? রাসুলুল্লাহ (স.) উত্তরে বললেন : কোনো মানুষ সম্পর্কে তোমার এমন কিছু আলোচনা করা যেটা সে পছন্দ করে না। প্রশ্নকারী বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! যদি কথা সত্য হয়? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন : তুমি মিথ্যা কথা বললে তো সেটা অপবাদ হয়ে যাবে। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক : ৩৬১৮, আল-জামেলি ইবনে ওহাব : ২৯৬)। সব মাজহাবের সব ইমামের সর্বসম্মত মত অনুসারে গিবত হারাম। তবে প্রয়োজনে বৃহৎ স্বার্থে গিবত করা জায়েজ আছে। যেমন কেউ যদি প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের দীন-ইমান, জীবন ও সম্পদের ক্ষতিসাধন করে, তাহলে মানুষকে সতর্ক করার জন্য তার গিবত করা জায়েজ আছে। যেমন কোনো ভণ্ড পীর, আদম বেপারি, নারী ও শিশু পাচারকারী, চাকরি দেওয়া, বিদেশ পাঠানো ইত্যাদি মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের টাকা আত্মসাৎকারী।

গিবতের ভয়াবহ পরিণতি

হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন : মেরাজের রাতে আমি তামার নখবিশিষ্ট কিছু মানুষকে দেখতে পেলাম, তারা নিজেরা নিজেদের মুখে ও বুকে চপেটাঘাত করছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে জিবরাইল! এরা কারা? তিনি উত্তর দিলেন, এরা হলো ওই সমস্ত লোক যারা দুনিয়ায় মানুষের মাংস ভক্ষণ করত, মানুষের মানহানি করে বেড়াত (গিবত করত)। (তাফসিরে ইবনে কাসির : খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ৩৯৭)। কিয়ামতের দিন গিবতকারীর সমস্ত আমলের সওয়াব যাদের গিবত সে করেছিল, তাদের প্রাপ্য অনুযায়ী বণ্টন করে দেওয়া হবে। তাতে যদি তাদের প্রাপ্য পরিশোধ না হয়, তাহলে তাদের গুনাহ গিবতকারীর আমলনামায় চাপানো হবে। অতঃপর সে সীমাহীন পাপের বোঝা নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।

রোজাদারের জন্য গিবতের ক্ষতি

হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, একবার রাসুলুল্লাহ (স.) লোকদের নির্দেশ দিলেন যেন আজ তারা রোজা রাখে এবং বলে দিলেন কেউ যেন আমার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ইফতার না করে। আদেশমতো সবাই রোজা রাখল, সন্ধ্যাবেলা এক লোক এসে বলল, আমি আজ রোজা পালন করেছি। সুতরাং আমাকে অনুমতি দিন আমি ইফতার করি। রাসুলুল্লাহ (স.) তাকে অনুমতি দিলেন। এভাবে সবশেষে এক লোক এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার পরিবারের দুজন মহিলা আজ রোজা রেখেছেন। আপনি অনুমতি দিন তারা ইফতার করুক। রাসুলুল্লাহ (স.) কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। লোকটি একই কথা পুনরায় বলল। রাসুলুল্লাহ (স.) এবার বললেন : তারা রোজা রাখেনি। যারা সারা দিন মানুষের মাংস খেল, তারা রোজা রাখল কী করে? সত্যিই যদি তারা রোজা রেখে থাকে তাহলে তুমি গিয়ে তাদের বমি করতে বলো। তারা তাই করল এবং উভয়ে কিছু জমাট রক্ত বমি করল। অতঃপর লোকটি এসে রাসুলুল্লাহ (স.)-কে সংবাদ দিলে রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন : এ অবস্থাতেই যদি তাদের মৃত্যু হতো, তাহলে জাহান্নামের আগুন তাদের খেয়ে ফেলত। (তাফসিরে ইবনে কাসির) হাদিসটি জইফ হলেও আকিদা এবং আহকাম সম্পর্কিত না হওয়ায় উদ্ধৃতি যোগ্য। সুতরাং রোজা রেখে গিবত বা পরনিন্দার অর্থ হলো ইচ্ছাকৃত নিজের রোজাকে দুর্বল ও সওয়াবশূন্য করে ফেলা এবং ভয়াবহ পরিণতি জাহান্নামের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

লেখক : পেশ ইমাম ও খতিব, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ।



মন্তব্য চালু নেই