“খুব ছোটবেলাতেই দেখতে পাই বাবার সাথে কাজের বুয়ার অবৈধ সম্পর্ক…”

“আপু সাধারণত কোন ছেলে হয়তো মেসেজ করেনা। আমি এর আগেও মেসেজ লিখে আবার ডিলিট করে ফেলেছি। পাঠানো হয়নি। যাই হোক মূল ঘটনাতে আসি।

আমি আমার ফ্যামিলির একমাত্র ছেলে। বাড়ি কুষ্টিয়াতে। বাবা এখানেই একটা ব্যবসা করেন আর মা একটা সরকারী ব্যাঙ্কের সিনিয়ার অফিসার। তাদের সেপারেশন হয়ে গেছে। আমি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন টের পাই আমাদের কাজের বুয়ার সাথে আমার বাবার অবৈধ শারিরীক সম্পর্ক আছে। বুঝতেই পারছেন ওটা আমার ইমোশনালি কিরকম হিট করেছিল। আর মোটা বলে স্কুলেও বুলিড হতাম ক্লাসমেট আর টিচারদের দ্বারা। উল্লেখ্য যে স্কুলটা কুষ্টিয়ার সেরা প্রাইভেট স্কুলগুলোর একটা।

যাই হোক ক্লাস ফাইভের শেষের দিকে আম্মু বুঝতে পারে যে আমি আমি বাবার ওই অবৈধ সম্পর্কের কথা জানি। তাই এর প্রভাব যেন আমার উপর না পড়ে সেই জন্য আমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেয় কুমিল্লাতে। আর ক্লাস থ্রী থেকেই আমার রেজাল্ট ক্রমাগত খারাপ হওয়া শুরু করে ফার্স্ট বয় থেকে কোন রকমে পাস করা স্টুডেন্টে ট্রান্সফর্মড হয়ে যাই। সেখানেও বুলিড হতাম ভিন্ন উচ্চারণ আর মোটা হওয়ার জন্য। আর রেজাল্ট ক্লাস সিক্সে জঘন্য রকমের খারাপ হয়। রিতীমত সেভেনে প্রমোশন নিয়ে টানাটানি। যাই হোক আমাদের তৎকালীন ক্লাসটীচার আর হাউজমাস্টারের জন্য প্রমোশন হয়। রেজাল্ট মোটামুটি করতে থাকি আগের বছরের তুলনাতে। সাথে স্কুলের বাস্কেটবল টীমে আমাকে নেয় নিখুঁত স্কোরার হিসেবে। ক্লাস সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষার পরে ছুটিতে যাওয়ার সময় আম্মু আমাকে জানায় তাদের সেপারেশন হয়ে গেছে। এরপর থেকে আমি আম্মুর সাথেই থাকি। এই সেপারেশনের ধাক্কা সামলাতে গিয়ে আমি বাস্কেটবলটাকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরি। গল্পের বই আর মিউজিক প্লেয়ার হোস্টেলে ব্যান্ড আইটেমের লিস্টে ছিল। সেটা আরেকটা কারণ । সেটাও ছাড়তে হয় একটা ইনজুরির জন্য।

এরপরের গল্প ছোট। রেজাল্ট কোনমতে পাশ করে যাচ্ছিলাম। এসএসসির টেস্ট পরীক্ষাতে এক সাবজেক্টে ফেল করার জন্য ইয়ার ড্রপ আসে একটা। তারপরের বছর পরীক্ষা দিয়ে এ প্লাস পাই। ঢাকার একটা নামকরা কলেজেও ভর্তি হই। কিন্তু ততদিনে আমার ভেতরে পুরানো মানসিক ট্রমাগুলা পাকাপোক্ত ভাবে বিষণ্ণতাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফলাফল কলেজ ড্রপআউট। এখন ডিপ্লোমা করছি কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইন্সটিউটে। সেখানেও রেজাল্ট খুব একটা সুবিধার না। বাবা আমাদের কোন খবর রাখেননা বা কোন দায়িত্ব পালন করেননা। যেহেতু কোন বড়ভাই বা বোন নেই মেন্টাল সাপোর্টের জন্য সেদিক দিয়েও আমি ভালনারেবল। আমার ফ্রেন্ড বলতেও আদতে কিছু নেই। যা আছে তাকে অ্যাকুইন্টেন্স বলা যায় খুব বেশি হলে। আত্মীয় স্বজনরা বা কাজিনরা একটু করুণার দৃষ্টিতে তাকায় আর সবসময় ড্রপআউটের জন্য কথা শোনায় দেখে ওদের সাথেও যোগাযোগ রাখিনা। আম্মুর সাথেও আমি খুব একটা ফ্রি না।

বাবার সাথে আট আটবছর হল আমার কোন যোগাযোগ নেই। মাঝে গাঁজা ধরেছিলাম। এখন প্রায় দেড় বছর আমি এদিক থেকে পরিষ্কার। নেশা বলতে সিগারেট। তাও ওইটা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছি। মাঝে মাঝে মনে হয় সুইসাইড করি। আবার ভাবি মানুষ তাহলে বলবে ছেলেটা কাপুরুষ ছিল। যে কয়টা রিলেশন হয়েছিল এ পর্যন্ত সেগুলাও টেকেনি। এমন না যে ব্রেকআপের মাঝে তিক্ততা ছিল। এখনো সবার সাথেই যোগাযোগ আছে। আপু সম্পূর্ণ একলা হাঁটছি জীবনের পথে। আগে হালকা লেখালেখি, আবৃত্তি বা বিতর্ক করতাম। এখন সেগুলোতেও কোন উৎসাহ পাইনা যেমন পাইনা বই পড়া বা গান শোনাতে। আস্তে আস্তে জীবনের মায়াও নাই হয়ে যাচ্ছে। এখন আমার কী করা উচিত? সাইকোলজিস্টের কাছে কাউন্সেলিং নিচ্ছি তিন বছর। কিন্তু অবস্থা দিনদিন আরো খারাপ হচ্ছে। আর আমার কোন ধর্মের প্রতি কোনরকম বিশ্বাস নেই।”

পরামর্শ:
ভাইয়া, আপনি যে এত স্পষ্ট করে গুছিয়ে চিঠিটা লিখেছেন, তাতে কিন্তু মোটেও মনে হচ্ছে না যে আপনার মানসিক অবস্থা এলোমেলো। বরং বোঝা যাচ্ছে যে আপনি খুবই শক্ত মনের একজন মানুষ। আপনি দুঃখী। ভীষণ দুঃখী। কষ্ট পেতে পেতে মাঝে মাঝে আমরা এমন একটা অবস্থায় চলে আসি, যখন আর কষ্টটা অনুভব করে পারি না। তার বদলে আক্রান্ত হই ভয়াবহ রকমের বিষণ্ণতায়। এক পর্যায়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই আমাদের মাঝ থেকে চলে যায়। আমার মনে হয় আপনার সাথেও তাই ঘটেছে। কীভাবে বুঝতে পারছি জানেন? কারণ আমার সাথেও ঠিক তাই ঘটেছিল।

আপনার কাউন্সিলিং-এ আপনার উপকার হচ্ছে না, কারণ আপনার এমন একজন বন্ধু দরকার বা এমন একজনের পরামর্শ দরকার যে আপনার অবস্থাটা বুঝবে। যাই হোক, আমি নিজের কিছু কথা বলি, হয়তো আপনার উপকারে লাগবে। আপনার স্কুল জীবনের কাহিনীর সাথে আমার কাহিনীর ভীষণ মিল। আমি ছোটবেলা থেকে খুব মোটা ছিলাম এবং মারাত্মক ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম। যত বড় হতে থাকলাম, এই ওজনের জন্য আর চুপচাপ স্বভাবের জন্য বুলিং এর মাত্রা ক্রমশ বাড়তে শুরু করলো। এমনকি টিচারদের কাছ থেকেও! এক পর্যায়ে অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে আমি স্কুলের নাম করে বাসা থেকে বের হয়ে স্কুলে যেতাম না, স্কুলের আশেপাশে কোথাও বসে থাকতাম। স্কুলে যাওয়ার কথা চিন্তা করলেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যেতাম। প্রচণ্ড ভয় পেতাম। তীব্র হতাশা কাজ করতো। এক পর্যায়ে আগের তুলনায় ফলাফল খারাপ হওয়া শুরু করলো। বাসায় বিষয়টি নিয়ে খুব শাসন করতো, ফলে আমার আত্মবিশ্বাস একেবারে কমে গেলো।

আপনার বাবার যেমন চরিত্রের সমস্যা ছিল আর আপনি এটা নিয়ে খুব আঘাত পেয়েছেন, আমার বাবার সমস্যা এই যে তিনি খুবই রাগী ছিলেন। এত রাগী যে বাবাকে দেখলে ভয়ে আওয়াজ বন্ধ হয়ে যেত। আমার কোন বন্ধু বান্ধবী ছিল না, কারণ বাবা কারো সাথে মিশতে দিত না। অসংখ্যবার বাবার হাতে মার খেয়েছি। অতিরিক্ত শাসনে খুব বিচ্ছিরি ভাবে বড় হয়েছি। আমার কোন সুখে শৈশব স্মৃতি নেই। আমি নিশ্চিত যে আপনারও তেমন একটা নেই। একা একা বড় হতে গিয়ে আমাদের দুজনেরই মনোজগৎ একেবারেই এলোমেলো হয়ে গেছে। আর এই সমস্ত কিছুর ফলাফল পড়েছে শিক্ষা জীবনে, সম্পর্কে, ক্যারিয়ারে… সত্যি বলতে কী, এখনো পড়ছে। এখনো দেখা যায় যে অনেক অনেক কিছুর সাথেই আমি সহজ হতে পারি না, অনেক কিছু মেনে নিতে পারি না। আমার কোন কাউন্সিলারের কাছে যাওয়ারও সুযোগ ছিল না আপনার মত বয়সে।

যাই হোক, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সমস্যা থেকে বের হওয়া যায় কীভাবে? উত্তর হিসাবে আমি সেটাই বলছি, যেটা আমি নিজে করেছিলাম। এভাবে জীবনে একের পর এক পরাজিত হতে হতে, একের পর কষ্ট পেতে পেতে আমি একসময় ফেডআপ হয়ে গেলাম। এবং ঠিক করলাম যে আমি এমন একটা কিছু করবোই, যেটা করলে সবাই আমার প্রশংসা করবে। মানুন আর নাই মানুন, প্রশংসা আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। আমি বেছে নিলাম এমন একটি বিষয়, যেটা আমি খুব ভালো পারি। লেখালিখি। মনে প্রাণে লেখালিখিকেই আঁকড়ে ধরলাম। এবং দেখলাম যে হ্যাঁ, আসলেই আমি পারি। খুব সহজেই সাফল্য ছিনিয়ে নিয়ে এলাম। ইন্টারের গণ্ডি পার হবার আগেই আমি পরিচিতি পেতে শুরু করেছি, বই পাবলিশ হয়েছে ইত্যাদি।

কাজ বন্ধু হয়ে গেলে আসলে আর বন্ধুর প্রয়োজন থাকে না। তারপরও জীবনের জন্য বন্ধু প্রয়োজন। বন্ধুত্ব করতে গিয়ে বারবার আমি প্রতারিত হয়েছি। তবুও ঠিক করলাম যে কিছু বন্ধু আমি তৈরি করবোই। এবং বেছে বেছে আমি তাঁদের সাথেই বন্ধুত্ব করেছি আজীবন, যারা আমারও মতই নিঃসঙ্গ ও যাদের আমার মতই কাউকে প্রয়োজন ছিল। দুজন নিঃসঙ্গ মানুষ একসাথে হয়ে গেলে কিন্তু কেউ আর নিঃসঙ্গ থাকে না। তবে হ্যাঁ, আমার বন্ধু সংখ্যা এখনো ভীষণ সীমিত। ক্ষমতায় কুলালে সকলেরই উপকার করার চেষ্টা করি, বিনিময়ে কিচ্ছু আশা করি না। আর এভাবেই কেবল ধরে রাখায় বন্ধুত্ব। নিঃস্বার্থ ভাবে…। কারণ আমি জেনে গিয়েছি যে জীবনটা একলা থাকারই নাম। কেউ আসলে কারো না। এটা নিয়ে আপনিও তাই মন খারাপ করবেন না।

বুঝতে পারছি আম্মুর সাথে আপনি ফ্রি নন। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন যে আপনি না থাকলে আম্মুর কী হবে? এই নারীর জীবন কেটেছে বীভৎস কিছু সত্যকে সঙ্গী করে। তবুও তিনি সয়ে গিয়ে বেঁচে আছেন আপনার দিকে তাকিয়ে, যেন আপনার জীবনটা সুন্দর হয়। এখন কি ভাই, আপনার কর্তব্য এই না যে মায়ের জন্য কিছু করা? মায়ের শেষ জীবনটা যেন সুখী কাটে, এই চেষ্টা করা তো আপনারই দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালন না করে চলে গেলে হবে?

দেখুন ভাই, মরে যাওয়ার ইচ্ছা কষ্ট পেলে সবার হয়। কিন্তু মৃত্যু যে কী ভয়ংকর, সেটার অনুভব কেবল জানেন তিল তিল করে কষ্ট ভুগে মরে যাওয়া মানুষেরা। বেঁচে থাকার জন্য বাহানার কোন অভাব নেই ভাই। মন ভরে প্রিয় একটা খাবার খাওয়ার পরও কি ভালো লাগে না? আমার তো লাগে। সূর্য ডোবার মিষ্টি দৃশ্য দেখেও কি মন ভালো হয় না? আমার কিন্তু হয়। কারণ জীবন মানে এইসব ছোট্ট প্রাপ্তি থেকেই সুখ খুঁজে নেয়া। খেয়ে পরে বেঁচে থাকা, একজন ভালোবাসা মানুষ খুঁজে পাওয়া… আপনিও পাবেন, পুরো জীবন তো এখনো পড়েই আছে। আমিও কিন্তু খুঁজে পেয়েছি আমার ভালোবাসা।

জীবনের রাস্তাটা সব সময় খোলা। কী হয় দেখার জন্য চ্যালেঞ্জ হিসাবে বেঁচে থাকতে পারেন। জীবন ভালো লাগছে না, চাইলে মরেও যেতে পারেন। কিন্তু মৃত্যুর রাস্তাটা কিন্তু একমুখী। মৃত্যুর পর কী হয়, আমরা কেউ জানি না। কিন্তু মৃত্যু পর ভালো না লাগলে কিন্ত ফিরে আসার কোন উপায় নেই।

তারচাইতে বেঁচে থাকার একটা চেষ্টা করাই কি ভালো না ভাই?প্রিয়ডটকম



মন্তব্য চালু নেই