খালেদার বার্তা নিয়ে লন্ডনে চার নেতা

নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি এখন বিএনপি। কারণ সরকারবিরোধী আন্দোলন বা লাগাতার অবরোধ-হরতালকে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে পারছে না দলটি এবং তাদের শরিকরা।

এ জন্য শুক্রবার খালেদা জিয়ার বার্তা নিয়ে লন্ডনে গেছেন দলটির চেয়ারপারসনের এক উপদেষ্টাসহ চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। তারা সেখানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে শেখ হাসিনার সরকারকে সংলাপে বাধ্য করানোর চেষ্টা করবেন বলে দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে।

দলীয় একাধিক সূত্রমতে, দলটির প্রধান খালেদা জিয়ার গ্রেফতারের শঙ্কা, স্বল্প সময়ের মধ্যে আন্দোলনের কার্যকর ফল পেতে অনিশ্চয়তা, ঢাকায় আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারকে চাপে ফেলতে না পারা, জ্যেষ্ঠ নেতাদের মাঠে না নামাসহ বেশ কিছু বিষয় এখন ভাবিয়ে তুলছে দলটিকে। যদিও দলের নেতারা বলছেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে আন্দোলন টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন তারা।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক এক বছর পর সরকারবিরোধী এই আন্দোলনের ডাকে তৃণমূলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও ঢাকায় কার্যত কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না দলটি। উপরন্তু যেকোনো সময়ে বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হতে পারে বলে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে হুমকি রয়েছে। এ অবস্থায় আন্দোলনে দীর্ঘসূত্রতা হলে দলটি আরো গভীর ফাঁদে পড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন রাজনীতিসংশ্লিষ্টরা।

তবে দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি এই মুহূর্তে আন্দোলন টেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই ভাবছে না। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হতে পারে- এই ব্যাপারটি আমলে নিয়েই আগাম প্রস্তুতি আর রণপরিকল্পনার সিদ্ধান্ত একাই নিয়েছেন দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া। তিনি গ্রেফতার হলে দলের কোন পর্যায়ের নেতারা কীভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবেন, সেই ছকও কষছেন তিনি।

সূত্রগুলো বলছে, বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বেশ কিছু জ্যেষ্ঠ নেতা এরই মধ্যে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে ডাকসাইটে চলে গেছেন। যাতে খালেদা জিয়া গ্রেফতার হলে তারা সংকটকালীন মুহূর্তে দলের হাল ধরতে পারেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের দাবি অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপের আহ্বান জানালেই কেবল কর্মসূচি থেকে সরে আসবে জোটটি। এ ছাড়া কোনো অবস্থাতেই অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হবে না। বরং অবরোধের মধ্যেই লাগাতার হরতালের চিন্তা-ভাবনা করছে বিএনপি। নেতা-কর্মীদের ওপর সরকারের ‘নির্যাতন’ যত বাড়বে, আন্দোলন তত কঠোর হবে বলে মত দিচ্ছেন তারা।

এরই মধ্যে রোববার ভোর ৬টা থেকে ৩৬ ঘণ্টার হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে, সরকারের ‘নাশকতার’ ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে এবং ২০ দলীয় জোটের ১০ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে এই কর্মসূচির ডাক দিয়েছে দলটি। জানা গেছে, আসছে এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন হরতাল-অবরোধ শিথিল করা হচ্ছে না। তবে পরীক্ষা অবরোধের আওতামুক্ত রাখা হবে, যেমনটি করা হয়েছে ‘ও’ লেভেল পরীক্ষার ক্ষেত্রে।

বিএনপির চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, ঢাকার আন্দোলন নিয়ে এবারও আশাহত হয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। আব্বাস-সোহেলের ওপর আস্থা রাখলেও তারা আস্থার প্রতিদান দিতে পারেনি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পূর্ব ‘ব্যর্থ আন্দোলনে’ অভিযুক্ত ঢাকা মহানগরের তৎকালীন আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকার পথেই হাঁটছে এই কমিটি। টানা ১৯ দিন সারা দেশ থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন থাকলেও সরকার তেমন চাপ অনুভব করছে না। বিশেষ করে, ঢাকায় আন্দোলন জমাতে না পারাই এর কারণ হিসেবে মনে করছে দলটি।

তবে ঢাকা মহানগর বিএনপি কার্যকারিতা আর জ্যেষ্ঠ নেতাদের চেয়ে মধ্যম সারির নেতাদের ওপরেই আস্থা রাখছেন লন্ডনে অবস্থান করা দলটির আরেক নীতিনির্ধারণী নেতা। কূটনৈতিক লবিং এবং আন্দোলনে মধ্যম সারির নেতাদের নির্দেশ দেওয়ার জন্য ওই নেতা ১৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করে দিয়েছেন। এতে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. এম ওসমান ফারুক, সাদেক হোসেন খোকা, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মাইদুল ইসলাম প্রমুখ। যারা প্রত্যেকেই এই মুহূর্তে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। এই কমিটিতে আছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টা, যিনি বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক সংস্থায় দায়িত্ব পালন করেছেন।

একটি সূত্র জানায়, লন্ডন থেকে গঠন করা ওই কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য সার্বক্ষণিকভাবে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, জেলা কমিটির প্রধান, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আরেকটি অংশ ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আর কমিটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, স্বল্প সময়ের মধ্যে আন্দোলনের ফল চায় বিএনপি। দলটি মনে করছে, দীর্ঘ সময়ে চলতে থাকলে আন্দোলন জনসমর্থন হারাবে। সে জন্য আরো কঠোরভাবে কর্মসূচি পালনের জন্য নেতা-কর্মীদের ওপর নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। সে জন্য সরকার সব ধরনের নিরাপত্তা তুলে নিলেও শিগগির গুলশান কার্যালয় ছাড়ছেন না বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। যত দিন অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে তত দিনই কার্যালয়ে থাকবেন তিনি। আন্দোলনকে আরো বেগবান ও সক্রিয় করতে এখান থেকেই কর্মসূচির সার্বিক বিষয় মনিটর করবেন বিএনপির প্রধান।

গুলশান কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, অফিসে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন খালেদা জিয়া। নেতাদের সঙ্গে ফোনালাপের সুযোগ রয়েছে সেখানে। রয়েছে ইন্টারনেট সুবিধাও। দেশের ভেতরে ও বাইরেও যোগাযোগ রাখতে পারছেন। কার্যালয়ে ফ্যাক্স থাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফ্যাক্সের মাধ্যমেও অবহিত হচ্ছেন তিনি। সারা দেশে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অবরোধ পরিস্থিতি সব সময় তাকে অবহিত করছেন চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল ও বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। কিন্তু গুলশানের নিজ বাসায় এসব সুবিধা নেই। সে জন্য কার্যালয়েই থাকছেন তিনি।

বিএনপি নেতাদের মতে, এভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারলে সরকার আলোচনায় বসতে বাধ্য হবে। ইতিমধ্যে সব স্তর থেকেই সংকট নিরসনে আলোচনায় বসার প্রস্তাব জোরালো হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ছাড়াও বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোও চলমান সংকট নিরসনে দুই পক্ষকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানাচ্ছে।

জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে (অব.) মাহবুবুর রহমান  বলেন, শুধু দলের জন্য নয়, দেশের জন্য ওভারঅল কঠিন সময় যাচ্ছে। একদিকে সরকার সংলাপ না করার বিষয়ে অনড়, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন আন্দোলন প্রতিহতের। এ অবস্থায় বিরোধী দলের অবরোধে কার্যত ঢাকা অবরুদ্ধ হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জনজীবনও অস্থিরতার মধ্যে আছে। বিএনপির চেয়ারপারসন টানা অবরোধ কর্মসূচি করবেন বলে জানিয়েছেন মাহবুবুর রহমান।

তিনি বলেন, সবাই প্রত্যাশা করেছিল, সংকট সমাধানে সরকার এগিয়ে আসবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সবাই সংলাপের আহ্বান জানালেও তারা (সরকার) এ বিষয়ে এগিয়ে আসছে না। এ অবস্থায় সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী সবার সংলাপে বসতে সরকারকে চাপ দিতে হবে। তেমনি বিরোধী দলকেও কর্মসূচি প্রত্যাহার করে আলোচনা বসার আহ্বান জানাতে হবে। সরকারের উচিত দ্রুত সংলাপের মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মাধ্যমে সমঝোতায় আসার। অন্তত জাতির মঙ্গলের জন্য দুই দলকেই সংলাপে বসতে হবে।



মন্তব্য চালু নেই