ক্রসফায়ারে ‘নিয়ন্ত্রিত’ অবরোধের নাশকতা

৬ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে চলছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ কর্মসূচি। বুধবার ছিল এর ১৬তম দিন। এর মধ্যে বিভাগ কিংবা জেলা পর্যায়ে অবরোধের সঙ্গে হরতালও পালিত হয়েছে বেশ কয়েকদিন।

অবরোধের প্রতিদিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও ঘটেছে গাড়িতে আগুন ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা।

এর মধ্যে ৪ থেকে ১৮ জানুয়ারি রাজধানীতে ৮৬টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। তবে বুধবার পর্যন্ত শেষের কয়েকদিনে গাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ নাশকতার হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম।

বিশেষ করে ১৬ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর মতিঝিলের এজিবি কলোনি ও ২০ জানুয়ারি খিলগাঁওয়ের জোড়াপুকুর খেলার মাঠের পাশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিনজন নিহত হওয়ার পর নাশকতার পরিমাণ আরও অনেক কমেছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (গুলশান) লুৎফুল কবির বলেন, আগেও যেভাবে নাশকতাকারীদের প্রতিরোধ করা হয়েছে, এখনও সেভাবে করা হচ্ছে। ক্রসফায়ারের (বন্দুকযুদ্ধ) সঙ্গে এর কোন সম্পৃক্ততা নেই। ল’ অ্যান্ড অর্ডার রক্ষা ও সিচ্যুয়েশন কন্ট্রোলের জন্য যা করা দরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাই করবে। এখন দুর্বৃত্তরা যদি ক্রসফায়ারের ঘটনায় নাশকতা কমিয়ে দেয় তাহলে এটি ভাল সংবাদ।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর কন্ট্রোল রুমের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এনায়েত হোসেন  বলেন, গত তিন-চারদিন ধরে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা অনেক কমেছে। অবরোধের আগের দিন থেকে অবরোধ চলাকালীন দিনগুলোতে সন্ধ্যার পর থেকেই গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

এনায়েত হোসেন আরও বলেন, কয়েকদিন এমন হয়েছে সন্ধ্যা থেকে প্রতি আধঘণ্টা পর পর একটি করে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে। তবে প্রতিটি ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নির্বাপণে সক্ষম হয়েছে।

‘বন্দুকযুদ্ধে’র তিনটি ঘটনার মধ্যে ১৬ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে মতিউর রহমান নামে এক ছাত্রদল নেতা নিহত হন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি মো. শাহজাহান মিঞা দাবি করেছেন, পরিকল্পিতভাবে র‌্যাব মতিউরকে হত্যা করেছে।

র‌্যাব-৫ এর চাঁপাইনবাবগঞ্জ ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর কামরুজ্জামান পাভেল জানান, নাশকতার অভিযোগে যৌথবাহিনীর হাতে আটক মতিউরকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গেলে ৪০-৫০ জন র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে র‌্যাব পাল্টা গুলি চালায়। মতিউর পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।

১৯ জানুয়ারি ভোরে রাজধানীর মতিঝিলের এজিবি কলোনীতে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন নড়াইল পৌরসভার কাউন্সিলর ও জামায়াত নেতা ইমরুল কায়েস। এখানেও পুলিশ ধরে নিয়ে তাকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেছে কায়েসের পরিবার ও জামায়াতে ইসলাম।

কিন্তু মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (পূর্ব) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর  বলেন, কায়েসসহ আরও কয়েকজন নাশকতার উদ্দেশ্যে এজিবি কলোনিতে অবস্থান করছিল। গোয়েন্দা পুলিশ তাদের চ্যালেঞ্জ করলে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এরপর পুলিশ পাল্টা গুলি ছুড়লে কায়েস গুলিবিদ্ধ হয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশকে আক্রমণ করে নাশকতা করাই ছিল তার মূল লক্ষ্য। সে এই উদ্দেশ্যেই ঢাকায় অবস্থান করছিল।

পরদিন ২০ জানুয়ারি ভোররাতে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের জোড়াপুকুর খেলার মাঠের পাশে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান জনি। পরিবার ও ছাত্রদলের দাবি, পুলিশ পরিকল্পিতভাবে জনিকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে।

তবে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) কৃষ্ণপদ রায়  বলেন, গোয়েন্দা পুলিশের হাতে আটক জনিকে নিয়ে অভিযানে গেলে নাশকতাকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লে পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এরপর জনি বন্দুকযুদ্ধের কবলে পড়ে নিহত হয়। জনি একজন নাশকতাকারী। মৎস্য ভবনে পুলিশের গাড়িতে বোমা হামলার ঘটনায় সে জড়িত ছিল।

এ ঘটনাগুলোর পর বুধবার (২১ জানুয়ারি) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ও মিরপুর সনি সিনেমা হলের সামনে দুইটি গাড়িতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। আগের দিন মঙ্গলবার ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে ভোর পৌনে ৫টার দিকে একটি গণমাধ্যমের (যমুনা টিভি) গাড়িতে আগুন এবং ১৫টি ককটেল বিস্ফোরণ করে দুর্বৃত্তরা। সোমবার গুলিস্তান মাজারের সামনে একটি ও মতিঝিলের মধুমিতা সিনেমা হলের সামনে একটি স্টাফ বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।

কিন্তু ৪ থেকে ১৮ জানুয়ারি রাজধানীতে ৮৬টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে ১৮ জানুয়ারি একটি, ১৭ জানুয়ারি ৭টি, ১৬ জানুয়ারি ৬টি, ১৫ জানুয়ারি দুইটি, ১৪ জানুয়ারি ৬টি, ১৩ জানুয়ারি ৩টি, ১২ জানুয়ারি ৪টি, ১১ জানুয়ারি ৪টি, ১০ জানুয়ারি ১১টি, ৯ জানুয়ারি ৩টি, ৮ জানুয়ারি ১১ টি, ৭ জানুয়ারি ৪টি, ৬ জানুয়ারি ৮টি, ৫ জানুয়ারি ৪টি ও ৪ জানুয়ারি ১২টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ছাড়া কয়েকশ ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মতিঝিল) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, এমন নয় যে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নাশকতা ঠেকাতে সব সময়ই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রতিদিনই তো নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই