কোথায় সেই আধুনিক-রোমান্টিক পুরুষেরা?

আপনি যতই মিষ্টি মিষ্টি শিহরণ তোলা প্রেমে পড়েন না কেন অধিকাংশ পুরুষই প্রেমকে খুবই প্রারম্ভিক একটা বিষয় মনে করে। অতি দ্রুতই দুচারটে রোমান্টিক কথা বলা হয়ে গেলে তারা বিছানার দিকে যায়। ঐ যে একটা গল্প আছে, গ্রাম থেকে বিয়ে করে আনা নতুন স্ত্রীকে স্বামী চাঁদ দেখিয়ে বলছে,

: দ্যাখো, কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে, বাতাস বইছে, ফুল ফুটেছে…বউ মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল,

: হ, বুঝছি বুঝছি, অহন কাপড় খোলা লাগবো তো?…

গল্পটা অতি প্রচলিত হলেও সত্য। জগতে রোমান্টিক পুরুষ আসলেই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীর মতোই দুর্লভ। কিন্তু অভিযোগ করেন আর যাই করেন, প্রেমে তো পড়তে হয় সেই পুরুষদেরই। আমরা তো আর সমকামি নই, তাই যতই অভাব-অভিযোগ থাক, পুরুষই সই। বড় মুশকিল।

আবার যদি বা পুরুষ খুব রোমান্টিক হয়ে আপনার প্রেমে পড়েও, আপনারই সাথে চাঁদ আর জ্যোছনার, কবিতা আর বৃষ্টির সমঝদার হয়ও, সেই সৌখিন পুরুষও পরিণতিহীন প্র্রেম কিন্তু মানতে পারবে না। অধিকাংশই। এসময়ের প্রেমে, নারী- আপনাকে কিছু না কিছু দিতে হবেই। হয় ব্রান্ডের ঘড়ি, না হয় স্যুটের কাপড় অথবা আড়ং এর সিল্কের পাঞ্জাবী, না হয় সংসার করার প্রতিশ্রুতি অথবা শরীর। শুধু ভালোবাসায় এখন আর চিড়ে ভেজে না। শুধুই মনের কথা বলার জন্য, শুধুই আপনার ঘোর একাকীত্বে আপনার সাথে কফির মগ ঠোঁটে তোলার জন্য আপনি কাউকে পাবেন, এত সহজ নয়।

অধিকাংশ পুরুষই বোঝে না অভিসার এর অর্থ। সুনেত্রা ঘটকের সেই কথাটা। অভিসার? অভিসার মানে যাওয়া। কিন্তু যাওয়া অতটা নয়, যতটা যেতে চাওয়া।

এবার আসি আধুনিক নামাঙ্কিত পুরুষদের কথায়। এক শ্রেণীর পুরুষ দেখতে পাই, যারা ঘোমটার নীচে খেমটা নাচাটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আমি আমার পেশার শুরু থেকেই দেখে আসছি, কোন পার্টিতে গেলে, মদের গ্লাস এগিয়ে দেন সহকর্মী পুরুষেরা। কোন মদটা খেলে ভালো লাগবে তাও বাতলে দেন এইসব আধুনিক পুরুষ। এবং খেয়ে, আড্ডা দিয়ে, হেসে, জোকস বলা শেষে পরদিন যখন আরও পাঁচজনের সঙ্গে দেখা হয়, তারা খুব অবলীলায় বলেন, আরে ঐ মেয়েটা যা খেলো না! দারুণ খোর!

স্বাভাবিকভাবেই তারা আমার বা আমার মতো কেউ খেলে তাদের সুখ্যাতি করার জন্য এসব বলে না। এই মেয়েগুলা ভালো না, উচ্ছৃঙ্খল-এইটা বলাই উদ্দেশ্য।

এটা তো তাও বাইরের কথা। থার্টি ফার্স্ট নাইটে আমার স্বামীর সাথে লিকার খাওয়ার ছবি দিয়েছিলাম ফেসবুকে, জাস্ট ফান করতেই। ঠারে-ঠোরে তো বটেই, অনেক পুরুষ সরাসরিও আপত্তি জানালো, এভাবে দেয়াটা উচিত হয়নি। মদ খেলেই কেউ আধুনিক হয়ে যায় না, কিন্তু খেলেই বা কি আসে-গেল? সমাজের আধুনিক পুরুষদের কেন এটাও গায়ে লাগলো, আমার বোধগম্য হয় না!

আরেক শ্রেণীর পুরুষের কথা জানি। তারা স্ত্রী বা বান্ধবীকে সবরকম সহায়তা করার ভান করেন। আপনি চাকরি করেন বা শিল্পের কোন শাখায় কাজ-আপনার সহধর্মী আপনাকে আপাত:দৃষ্টিতে সবরকম সহায়তা করবে। আপনাকে খু্ব উৎসাহ দেবে। আপনি যদি কাজে ভালো হন, আপনাকে নিয়ে তার কাছের মানুষদের কাছে রীতিমতো গর্ব করবে। আপনাকে বলবে, আরও প্রফেশনাল হও। আপনি শিল্প-সাহিত্যে কাজ করলে আপনাকে আরও আরও ভালো করার জন্য উপদেশ দেবে। কিন্তু এসব কাজ সে আশা করবে, যেন আপনি তার এবং সংসারের প্রতি সকল দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে প্যারালালি করেন।

সংসার এবং তার নিজের দাবী কিন্তু সে নিরুচ্চারে ছেড়ে দেবে না। অর্থাৎ আপনার মধ্যে সে একজন সুপার উইম্যান খুঁজবে। সেই সুপার উইম্যান যে সংসারে এবং আপনার প্রতি দায়িত্বে দক্ষ, আবার প্রফেশনেও। এই দক্ষতা আপনি কিভাবে অর্জন করবেন তা দেখার বিষয় তার নয়। যেন দক্ষতা বা কবিতা লেখা আকাশ থেকে পয়দা হয়, যেন এসব এমনি এমনিই হয়ে যায়। অর্থাৎ যতই আধুনিকতা দেখাক, মূলত: আপনাকে পেছনে টেনে ধরার নানা আয়োজন তারা করেই রাখে, অনেকসময় তাদের নিজের অজান্তেও হয়তো করে। কিন্তু করে। কাকে যে বলে, আধুনিক পুরুষ! আবুল হাসানের কবিতার মতোই, তারা চোখ ভরে দেখতে চায়, কিন্তু রঞ্জন রশ্মিটা চেনে না, বুক ভরে শ্বাস নিতে চায়, কিন্তু অক্সিজেনের পরিমাণটা জানে না।

তবুও স্বপ্ন…একদিন হাতের উপর হাত রাখা সহজ হবে। সারাজীবন বইতে পারা সহজ হবে!

লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও লেখক।

উইমেন্স চ্যাপটার থেকে সংগৃহীত



মন্তব্য চালু নেই