কে ছিল ফাহিম? কী ছিল তার টার্গেট?

ধারাবাহিক গুপ্ত হত্যা আর জঙ্গি হামলার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান চলার মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক কলেজশিক্ষককে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা চালায় কয়েকজন যুবক। এর মধ্যে ছিলেন ফাহিম (২০) নামের এক কলেজছাত্র। কিন্তু কিলিং মিশন শেষ করার আগেই আশপাশের লোকজন ঘটনা জেনে যাওয়ায় জনতার হাতে আটক হন ফাহিম।

তবে শেষ রক্ষা হয়নি তার। শিক্ষক হত্যাচেষ্টায় জড়িত অন্যদের ধরতে তাকে নিয়ে অভিযান চালানোর সময় শুক্রবার (১৮ জুন) ভোরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান ফাহিম। এ নিয়ে দেশজুড়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।

কে ছিল ফাহিম : দেশে প্রথমবারের মতো ব্যর্থ জঙ্গি হামলার পর জনতার হাতে আটক হওয়া যুবক ফাহিমের পুরো নাম গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম। গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তবে দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বাবা-মার সঙ্গে বসবাস করতেন ঢাকায়। বাবা গোলাম ফারুক একজন ব্যবসায়ী। মা সাধারণ গৃহিনী।

ঢাকার উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে এইচএসসির মেধাবী ছাত্র ছিলেন ফাহিম। এসএসসিতে পেয়েছিলেন জিপিএ-৫। কলেজে ওঠার পরেই এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে হয় পরিচয়। সেই বড় ভাইয়ের হাত ধরেই সে পা বাড়ায় ভিন্ন এক পথে। কলেজের সামনে এক লাইব্রেরিতে প্রায় প্রতিদিনই তারা বৈঠক করতেন। এরপরই সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীর সঙ্গে। তবে বাবা গোলাম ফারুক বা পরিবারের অন্য কেউ-ই ছেলের জঙ্গি সংশ্লিষ্টার কথা জানতেন না। ধর্মীয় বই-পুস্তক নিয়ে ছেলের ঘাঁটা-ঘাঁটি করার অভ্যাস সম্পর্কেই জানতেন তারা।

সূত্রমতে, হিযবুত তাহরীরে জড়িয়ে পড়ার পর ফাহিমের প্রথম অপারেশনই ছিল মাদারীপুর সরকারি নাজিমউদ্দিন কলেজের গণিত বিভাগের প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যায় অংশ নেয়া।

প্রথম অপারেশন : প্রথম অপারেশনে অংশ নিতে কয়েকদিন আগে বাসা থেকে বের হয়ে আসেন ফাহিম। এরপর বাবার মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠান। বাবাকে বলেন, ‘বিদেশ চলে গেলাম। এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। বেঁচে থাকলে আবারো দেখা হবে।’ এসএমএস পাওয়ার পরে বাবা গোলাম ফারুক রাজধানীর দক্ষিণখান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডিতে গত ১১ জুন সকালের পর থেকে ফাহিম নিখোঁজ বলে উল্লেখ করা হয়।

জীবনের প্রথম কিলিং মিশনেই ব্যর্থ: গত বুধবার (১৫ জুন) বিকেলে মাদারীপুর সরকারি নাজিমউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্রী হোস্টেলের সামনে প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীর ভাড়া বাসায় উপস্থিত হন ফাহিমসহ কিলিং মিশনে অংশ নেয়া তিন যুবক। শিক্ষককে তার নিজ বাসার মধ্যেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে যুবকরা। এসময় শিক্ষকের আর্ত চিৎকারে আশপাশের মানুষ ছুটে আসে ঘটনাস্থলে। অবস্থা বেগতিক দেখে হামলাকারী পালিয়ে গেলেও জনতার হাতে ধরা পড়ে ফাহিম। স্থানীয়রা তাকে পরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে।

মামলা দায়ের : ঘটনার পরে গুরুতর আহতাবস্থায় শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করতে এগিয়ে না আসায় ঘটনার একদিন পর বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) রাতে পুলিশের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করা হয়। মামলায় আটক ফাহিমের দেয়া তথমতে, সালমান তাসকিন সালিম (১৯), শাহরিয়ার হাসান পলাশ (২২), জাহিন (২৩), রায়হান (২৪) ও মেজবাহকে (২৪) আসামি করা হয়।

‘সফট টার্গেট’: সারাদেশে হিযবুত তাহরীরের অস্তিত্ব ও কার্যক্রম জাহির করাই ছিল প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যার মূল উদ্দেশ্য। তাদের এ মিশনের নামও দেয়া হয়েছে সফট টার্গেট। এ সফট টার্গেটের মূল কথা হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে সকল সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই, যারা সমাজে শ্রদ্ধাভাজন অথচ নিরীহ এবং ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত তাদের টার্গেট করা হয়। কেননা, এদের হত্যা করলে তারা পাল্টা আক্রমণ করতে পারে না। হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সংগঠনের শক্তি জানান দেয়ার ক্ষেত্রে নিরাপরাধ ভালো মানুষকে সফট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই এ কিলিং মিশনকে তারা নাম দিয়েছে ‘সফট টার্গেট’।

কী ছিল টার্গেট : গত ১৪ জুন ঘটনার আগেই মাদারীপুরে চলে আসে ফাহিম। এরপর অনুসরণ করতে থাকে শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে। ফাহিমসহ অন্য যুবকদের উদ্দেশ্য ছিল মাদারীপুরের মিশন শেষ করে তারা চলে যাবে দক্ষিণাঞ্চলে। এ অঞ্চলের আরো ১০ জেলায় ‘সফট টার্গেট’ অনুযায়ী কাজ করার পরিকল্পনা ছিল তাদের।

কেন এ পথে আসা : হত্যাকাণ্ডের পর জনতার হাতে আটক হওয়া ফাহিমকে সোপর্দ করা হয়েছিল পুলিশের হাতে। বৃহস্পতিতার রাতে মামলা দায়েরের পর শুক্রবার (১৭ জুন) বিকেলেই ফাহিমকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের কাছে আবেদন জানায় পুলিশ কর্মকর্তারা। পরে আদালতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পুলিশি রিমান্ডে ফাহিম প্রথমে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় নিষ্ফল অভিযানও চালায়।

এক পর্যায়ে ফাহিম পুলিশের কাছে স্বীকার করে, সে হিযবুত তাহরীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে কেন আর কী কারণে মেধাবী এই ছাত্র জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে পড়লো, কেনইবা সফট টার্গেটের মতো জঘণ্য অপরাধে আগ্রহী হয়ে উঠলো- সে সম্পর্কে বেশি কিছু জানতে পারেনি। এর আগে ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু হয়েছে।

ক্রসফায়ার : রিমান্ডে নেয়ার দ্বিতীয় দিনে (১৭ জুন) দিবাগত ভোরে ফাহিমের দেয়া তথ্য অনুযায়ী তাকে নিয়ে কিলিং মিশনে অংশ নেয়া অন্যদের ধরতে অভিযানে বের হয় পুলিশ। মাদারীপুর জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) কামরুল হাসানের নেতৃত্বে ২০ জন ফোর্সের দুটি টিম ওই অভিযান পরিচালনা করেন। জঙ্গিদের ধরতে জেলা সদর থেকে অন্তত ২০ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত বাহাদুরপুর ইউনিয়নের মিয়ারচর এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয় ফাহিমকে। মাদারীপুর থেকে বাহাদুরপুরের মূল সড়ক পার হয়ে কাঁচা-পাকা সড়ক ধরে একটু এগিয়ে যেতেই পুলিশের ওপর অতর্কিত গুলি চালায় ফাহিমের সহযোগিরা। এ সময় পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। এসময় ফাহিম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।

মিয়ারচর গ্রামবাসীর দেয়া তথ্যমতে, ধান ও পাট ক্ষেতের মাঝামাঝি জায়গায় ফাহিমের লাশ পড়ে থাকতে দেখতে পায় তারা। লাশের বুকে গুলির চিহ্ন ছিল। হাতে ছিল হ্যান্ডকাপ পরানো। অভিযান পরিচালনাকারী ডিবির এসআই কামরুল হাসান জানান, ঘটনাস্থল থেকে একটি বন্দুক, তিনটি গুলি ও ছয়টি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে।

মাদারীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউল মোর্শেদ বলেছেন, ‘বন্দুকযুদ্ধে নিহত ফাহিমের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডে জড়িত বাকিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই