কেমন ঢাকা চাই-রঙ মাখা সঙ নাকি ঝুঁকিমুক্ত?

অপরিকল্পিত ভবন গিজগিজ আর যানজটের নগরীতে একটু সৌন্দর্যের ছোঁয়া দিতে পুরাতন পলেস্তারা খসে যাওয়া ছাল ওঠা ভবনগুলোতে রঙ লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন মেয়র। আগেও বেশ কয়েকবার এ আহ্বান জানানো হলেও কেউ সাড়া না দেয়ায় এবার কঠোর হতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলছে, এবার নির্দেশ না মানলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কিন্তু গত সোমবার ভোরে ৬.৮ মাত্রার কম্পনে যেভাবে নগরবাসী আতঙ্কে ছুটাছুটি করলেন তাতে রাজধানীর ভবনগুলো কতোটা ভূমিকম্পসহন সেই প্রশ্ন আবার সামনে চলে এসেছে। এছাড়া বুধবার ভারতীয় বিজ্ঞানীরা আরো শক্তিশালী ভূমিকম্পের সতর্কতা দিয়েছেন।

ফলে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা রাজধানী ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণ না করে ভবনগুলোকে দর্শনধানীর বানাতে ডিএসসিসির নির্দেশনা নিয়ে একটু অস্বস্তিতে পড়েছেন নগরবাসী।

সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানীতে ৭৮ হাজারেরও বেশি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে শুধু সরকারি ভবনই আছে প্রায় ৫ হাজার। ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবেলায় বিশেষ ব্যবস্থায় এসব ভবন চিহ্নিত করে অপসারণ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে সরকার। কিন্তু এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারো। সিটি করপোরেশন বলছে এর দায়িত্ব রাজউকের। আর রাজউক দায় চাপাচ্ছে সিটি করপোরেশরেন ওপর।

ভবনগুলো অপসারণ করা না হলেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বলছে, ভূমিকম্প মোকাবেলায় তাদের ৭৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত আছে।

অথচ স্থানীয় সরকার আইনে বলা আছে, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো অপসারণ করবে সিটি করপোরেশন। পক্ষান্তরে ইমারত বিধিমালা ২০০৮ এর ২ অনুচ্ছেদে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণের দায়িত্ব রাজউকের। দুই আইনের দুই রকম ব্যাখ্যা দিয়ে এর দায় দায়িত্ব এড়িয়ে চলছে উভয়পক্ষই।

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা ভবনগুলো অপসারণের জন্য সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে বারবার নির্দেশ দেয়া হলেও কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। ভবনগুলোতে বসবাস করছে লাখ লাখ মানুষ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাজধানী ঢাকা। এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, স্বাভাবিক ভূমিকম্পে সিটি করপোরেশন অঞ্চলগুলোর মধ্যে অঞ্চল- ৩ কম, অঞ্চল-২ মাঝারি ও অঞ্চল-১ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। অঞ্চল ৪ ও ৫ এর বিশেষ বিশেষ স্থান অধিক ঝূঁকিপূর্ণ।

মূলত ভূগর্ভস্থ নরম মাটি, ভবনের মেয়াদ উত্তীর্ণ, বিল্ডিং কোড না মানা ও অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে রাজধানীর এসব ভবন এখন ঝুঁকিপূর্ণ।

ভূমিকম্পের মাত্রা অনুযায়ী রাজধানীর ঝুঁকির প্রবণতা নির্ধারণ করেছে সরকারের একটি সংস্থা। সে হিসাব অনুযায়ী, ৩ মাত্রার চেয়ে কম ভূমিকম্প- অতি মৃদু, ৩ মাত্রার ভূমিকম্প- মৃদু, ৪ মাত্রার ভূমিকম্প- হালকা, ৫ মাত্রার- মাঝারি, ৬ মাত্রার- শক্তিশালী, ৭ মাত্রার- তীব্র ও ৮ মাত্রার- অধিক প্রলয়ংকারী।

বিগত ১৫০ বছরের ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে ১৮৬৯ সালের জানুয়ারিতে ৭.৫, ১৮৮৫ সালের জুলাইয়ে ৭.০, ১৮৯৭ সালের জুনে ৮.৭, ১৯১৮ সালের জুলাইয়ে ৭.৩, ১৯৩০ সালের জুলাইয়ের ৭.১, ১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে ৭.০ এবং ১৯৫০ সালের আগস্ট মাসে ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। সে সময় দেশে বহুতল ভবনের সংখ্যা খুব কম থাকলেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশ। কিন্তু এখন বহুতল ভবনের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনও অগণিত। ফলে বড় মাত্রার কোনো ভূমিকম্প হলে নগরির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে ধারণা ভূতাত্ত্বিকদের।

২০০৮ সালে এক জরিপে, সাড়ে ৫ হাজার ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে চিহ্নিত করেছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু এ জরিপ পুরো নগরে চলানো হয়নি। ফলে সংস্থাটির কাছে নিজেদের তৈরি করা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সঠিক কোনো তলিকা নেই।

পক্ষান্তরে রাজউকের ৫৯০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ১২ লাখ ৫০ হাজার ভবন রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান শহরেই আছে ৩ লাখ ২৬ হাজার। আর হ্যারিটেজ বা ঐতিহ্যবাহী ভবন ২২৯টি। এছাড়া মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ৩২১টি। এর মধ্যে বিধি লঙ্ঘন করে নির্মিত ভবন আছে ৫ সহস্রাধিক। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে রাজধানীতে ৭০ হাজারেরও বেশি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ।

ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবনগুলোর অধিকাংশের রঙ নষ্ট ও পলেস্তারা বিহীন। কিছু কিছু ভবনে বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। এর মধ্যেই আসছে সিটি করপোরেশনের ভবন রঙ করার নির্দেশ। করপোরেশনের এমন নির্দেশকে কাজে লাগিয়েই পুরনো ও ঝুকিপূর্ণ ভবনকে রঙ মেখে নতুন করার প্রস্তুতিও নিচ্ছে অনেকেই। এতে করে রাজধানীতে ভাড়া বাসায় থাকা বিপুল সংখ্যক মানুষ বাসা ভাড়া নিতে গিয়ে প্রতারিত হতে পারেন বলে মনে করছেন গবেষকরা।

গত রোববার টিকাটুলীতে র‌্যাব-৩ এর কার্যালয়ে বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় ডিসিসির মেয়র সাঈদ খোকন বেমানান বা রঙ-পলেস্তারা নষ্ট বাড়িতে নতুন রঙ ও পলেস্তারা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকার সৌন্দর্য রক্ষা করা সকল নাগরিকের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। দখলদারকের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’

তবে সিটি করপোরেশনের যুক্তি হচ্ছে, নানা কারণে সৌন্দর্য হারাচ্ছে ঢাকা। এতে পর্যটকসহ রাজধানী বিমুখ হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। ফলে দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নানা বদনাম ছড়াচ্ছে। এ কারণেই নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সিটি করপোরেশন। এরমধ্যে নগরীর অবৈধ বিলবোর্ড অপসারণ করে এলইডি বিলবোর্ড স্থাপন, ফুটপাত দখলমুক্ত, পরিচ্ছন্ন নগরী, সবুজায়ন, রাতের মধ্যে নির্দিষ্ট স্থানে বর্জ্য ফেলা ও সড়ক মেরামতের কাজ চলমান রয়েছে।

এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটির মেয়র এক কথায় বলেন, ‘হাজারো সমস্যার নগর রাজধানী ঢাকা। এক দিনে সব সমস্যা সমাধান সম্ভবন নয়। আমাদের সব বিষয়ে কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে সব সমাধান করা হবে।’



মন্তব্য চালু নেই