কেমন ডাক্তার হবে এরা?

প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে দেশের মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে ভর্তি পরীক্ষার ফল বাতিল চেয়ে করা রিট আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। সুতরাং এ নিয়ে আর কথা হবেনা। আমাদের মেনে নিতে হবে সেকথা যেকথা বলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চারদিকে যখন হৈ চৈ, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে উত্তাল সামাজিক মাধ্যম এবং আনুষ্ঠানিক গণমাধ্যমও, তখন রবিবার দুপুরের আগেই খুব তড়িঘড়ি করে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে ফেলল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ফলাফল ভাল এবং আমাদের তা মেনে নিতেই হবে, কারণ সরকার বাহাদুর বলে কথা। তবে প্রতিবাদ হচ্ছে সারা দেশেই। প্রশ্ন উঠে, যখন একটা অভিযোগ উঠেছে, তখন কেন এমন অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ফল প্রকাশ করা হলো?

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ফলাফলকে ভাল বলছে, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগকে মানতে চাচ্ছেনা। তাহলে প্রশ্ন উঠে, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’র তিন কর্মকর্তার গ্রেপ্তারের কারণ কি? তদন্ত কমিটিওবা কেন গঠন করা হলো?

অর্থের বিনিময়ে (অংকটা আকাশ ছোঁয়া) যেসব শিক্ষার্থী প্রশ্নপত্র কিনেছে, তারা যখন ডাক্তার হবে, তারা আসলে ভবিষ্যতে কতটা ডাক্তার হবে, আর কতটা কসাই হবে, সেই হিসেবটা আগেভাগেই করে রাখা দরকার বলে মনে হচ্ছে। এবার ভর্তি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর উঠেছে ৯৪.৭৫। সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তিতে সর্বনিম্ন নম্বর ৭৭.৪। দেশবাসী জেনে অবাক হবেন যে, এরা এতই মেধাবী যে, ৮০ থেকে ৯০ নম্বর পেয়েছেন দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্নগুলো বিনিময় হয়েছে পরীক্ষার আগের রাত দেড়টা থেকে পরীক্ষার দিন সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত।

একদিকে কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, অন্যদিকে র‌্যাব মহাখালীর ডিওএইচএস এলাকা থেকে গত মঙ্গলবার মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত অভিযোগে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের কাছে পাওয়া গেছে থেকে ১ কোটি ২১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা মূল্যমানের বিভিন্ন ব্যাংকের চেক, নগদ টাকা ও ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন-উত্তরপত্র এবং ভর্তি পরীক্ষার নিবন্ধনপত্র।

যে কোনো পাবলিক পরীক্ষা মানেই এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস। সত্যিকারের মেধাবী ছাত্র ছাত্রী আর তাদের অভিভাবকদের জন্য এক ট্রমার নাম। আনন্দ আছে নিশ্চয়ই, তবে সেই গোষ্ঠীর জন্য তারা অর্থ দিয়ে যাকিছু করতে পারে, তা সেই সন্তানের জন্য প্রশ্নপত্র হলেও।

এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে সংস্কৃতি আমরা চালু করলাম, তা নিয়ে যারা উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছেন ভবিষ্যতে তারা আসলে কি করবেন? মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার কথাই যদি ধরি, তাহলে প্রশ্নপত্র কিনে যারা ডাক্তার হবেন তারা কি আসলে রোগীর চিকিৎসা করবেন, নাকি ডাক্তার নামে খুনি দলের সদস্য হবেন? বলাই বাহুল্য, এরা পরিশ্রম করে পড়বেনা, শিখবেনা কারণ এই শিক্ষার ভিত্তিটাই তাদের নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যদি হয় প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, তাহলে প্রতিকার কার কাছে? জানা গেল, মেডিকেল ভতির প্রশ্নের সর্বোচ্চ রেট উঠেছিল ১৫ লাখে। আটক হওয়া ইউজিসির সহকারী পরিচালক ওমর সিরাজ সম্পর্কে চমকপ্রদ সব তথ্য আসছে গণমাধ্যমে। তিনি কোনো এক দেশ থেকে এমন এক ডিভাইস এনেছেন যেটি থাকবে যেসব শিক্ষার্থীর কাছে যারা তাকে অর্থ দিয়েছে। পরীক্ষার হলে, সেই ছোট্ট ডিভাইসটি লাগানো থাকবে সেসব শিক্ষার্থীর কানে, কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশ্নের উত্তর বলে দেয়া হবে ইউজিসি থেকে।

অপরাধ যেনতেন নয়, ডিজিটাল সফিসটিকেটেড অপরাধ। প্রযুক্তির কি অসাধারণ ব্যবহার! সত্যি বলতে গেলে আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এখন সব ওমর সিরাজের মতো লোকেদের হাতে।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, বিএ, এমএ তো বটেই, গত কয়েক বছর বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছে বার বার। ফাঁস হয়েছে মেডিকেল বা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, চাকরির ইন্টারভিউসহ সকল প্রকার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্ন। আর যারাই এর সঙ্গে জড়িত থাকুক না কেন প্রতিকার হয়নি কখনোই। ধরা পড়েনি মূল হোতারা।

এখন এটা একটা বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে পরীক্ষা মানেই প্রশ্নপত্র পাওয়া যাবে। মেডিকেল পরীক্ষার স্বচ্ছতা প্রশ্নে সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তারা যা বলেছেন, যেভাবে গণমাধ্যমের খবরকে মিথ্যা বলেছেন তা দুর্ভাগ্যজনক।

সমস্যার গভীরে গিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। আসলে শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যারা জড়িত তারাই প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। কারণ প্রশ্ন তৈরি, ছাপা ও বণ্টন সীমিত কয়েকজন কর্মকর্তাসহ নির্দিষ্ট লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে যদি ফাঁস হয়, তাহলে বুঝতে হবে সর্ষের মধ্যেই ভুত আছে। রক্ষকরাই ভক্ষক।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

পরিচালক বার্তা, একাত্তর টেলিভিশন



মন্তব্য চালু নেই