কামারুজ্জামান : আটক থেকে ফাঁসি

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫শে মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এই ট্রাইব্যুনাল গঠনের ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দ্বার উন্মুক্ত হয়।

প্রথমে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হয়।

এরপর ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে হাইকোর্ট এলাকা থেকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের মামলায় মামলায় গ্রেফতার করা হয়। একই বছর ২ আগস্ট তাকে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।

ট্রাইব্যুনালের মুখোমুখি : কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ আব্দুর রাজ্জাক খান পিপিএম তদন্ত করেন।

তদন্ত শেষে তিনি ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর প্রসিকিউশনের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনালে জমা দেন রাষ্ট্রপক্ষ। তবে সেটি সঠিকভাবে বিন্যস্ত না হওয়ায় আমলে নেওয়ার পরিবর্তে ফিরিয়ে দেন ট্রাইব্যুনাল।

২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে পুনরায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন।

ওই বছরের ৩১ জানুয়ারি ৮৪ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১। ওই বছরের ১৬ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কামারুজ্জামানের মামলাটি প্রথম ট্রাইব্যুনাল থেকে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।

২০১২ সালের ৪ জুন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ আনা হয়।

২০১২ সালের ২ জুলাই কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৮১ পৃষ্ঠার ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উত্থাপন করেন প্রসিকিউটর একেএম সাইফুল ইসলাম ও নূরজাহান বেগম মুক্তা।

২০১২ সালের ১৫ জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) আব্দুর রাজ্জাক খানসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১৮ জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেন।

অন্যদিকে কামারুজ্জামানের পক্ষে বড় ছেলে হাসান ইকবালসহ মোট পাঁচজন সাফাই সাক্ষী সাক্ষ্য দেন।

২০১৩ সালের ২৪ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত এবং ১৬ এপ্রিল পাঁচ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এ কে এম সাইফুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট নুরজাহান বেগম মুক্তা।

অন্যদিকে ৩ থেকে ১৬ এপ্রিল ৪ কার্যদিবসে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিকী।

২০১৩ সালের ১৬ এপ্রিল বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায় রায় ঘোষণা অপেক্ষমান রাখেন ট্রাইব্যুনাল। ৯ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে এবং বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিয়া ও শাহিনুর ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল ২১৫ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণা করেন।

আপিলে কামারুজ্জামান : কামারুজ্জামান ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে ২০১৩ সালের ৬ জুন আপিল করেন। তবে সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় কামারুজ্জামানের দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করেননি রাষ্ট্রপক্ষ। ১০৫ পৃষ্ঠার মূল আপিলে মোট ১২৪টি যুক্তিতে দেখানো হয়।

আর এর সঙ্গে দুই হাজার পাঁচশ’ ৬৪ পৃষ্ঠার আনুষঙ্গিক কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আপিলের সার-সংক্ষেপ জমা দেন আসামিপক্ষ।

তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন নিজে এ আপিল মামলার শুনানিতে না থেকে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের পৃথক আপিল বেঞ্চ গঠন করে দেন।

বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হচ্ছেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

২০১৪ সালের বছরের ৫ জুন থেকে আপিল শুনানি শুরু হয়। ওই দিন থেকে মোট ১৭ কার্যদিবসে আপিল শুনানি শেষ হয়।

কামারুজ্জামানের পক্ষে আপিলে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, এসএম শাহজাহান ও অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম শুনানি করেন।

অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে চার কার্যদিবস শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

আপিল শুনানি শেষ হওয়ায় গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল মামলার রায় অপেক্ষমান (সিএভি) রাখেন আপিল বিভাগ।

গত বছরের ৩ নভেম্বর কামারুজ্জামানকে ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে আদেশ দেন আপিল বিভাগ।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কামারুজ্জামানের এ ফাঁসির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

এরপর ওইদিন রাতেই আপিল বিভাগ থেকে ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পৌঁছে দেওয়া হয় বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।

পরেরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ ট্রাইব্যুনাল-২ এর ৩ বিচারপতি মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেন। অন্য দুই বিচারপতি হচ্ছেন বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম।

পরে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মোস্তাফিজুর রহমান মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন। এর পর লাল কাপড়ে মোড়ানো মৃত্যু পরোয়ানা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কারাগারে পৌঁছানোর পর কামারুজ্জামানকে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়। তিনি আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ করে রিভিউ আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেন।

রিভিউ ও মৃত্যুদন্ড কার্যকর : সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী মানবতা বিরোধী অপরাধে মৃত্যদন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি রিভিউ করার জন্য ১৫ দিন সময় পান। বেধে দেওয়া সময়ের মধ্যে গত ৫ মার্চ ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেন কামারুজ্জামান। মোট ৭০৫ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বাতিল ও তার খালাস চান কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা। ৫ এপ্রিল রিভিউ আবেদনের ওপর কামারুজ্জামানের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

৬ এপ্রিল কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিয়ে মৃত্যদন্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।

৮ এপ্রিল এপ্রিল রিভিউ খারিজের রায় কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর পর তা কামারুজ্জামানকে পড়ে শোনানো হয়। এরপর জেল কতৃপক্ষ কামারুজ্জামানের কাছে জানতে চান তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন কি না। কামারুজ্জামান ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানালে ফাঁসি কার্যকরের উদ্যোগ নেয় কারা কর্তৃপক্ষ।

অবশেষে ১১ এপ্রিল রাত ১০টা ৩০ ‍মিনিটে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

অবশ্য, ১০ এপ্রিল ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে তা করা হয়নি।



মন্তব্য চালু নেই