‘কান্না নয়, তোমার আব্বু শহীদ হয়েছে’

মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার নিয়ে নানা সময়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করলেও শেষ পর্যন্ত দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষাকারী ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ‘শহীদ’ বলে দাবি করেছেন তার স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরী।

রবিবার সকাল ৯টার দিকে সাকার মরদেহ কড়া নিরাপত্তায় তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানের গহিরা গ্রামে পৌঁছালে জানাজার নামাজের জন্য সেটি নিয়ে যাওয়া হয় তাদের দাদার বাড়ি লাল বিল্ডিংয়ে। সাকা চৌধুরীর নতুন বাড়ি বায়তুল বিলাল থেকে পুরনো বাড়িতে পায়ে হেঁটে মেয়ে ফারজিন কাদের ও পুত্রবধূ দীনিয়া খন্দকার সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছানোর সময় মেয়েকে উদ্দেশে করে সাকাপত্নী এ কথা বলেন।

এ সময় ফরহাত কাদের চৌধুরী বলেন, ‘তোমরা একদম চোখের পানি ফেলবে না। কাঁদবে না। তোমার আব্বু শহীদ হয়েছে।’ এসব কথা বলে তিনি তাদের পারিবারিক মসজিদের আঙিনায় জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। এরপর সাকার মরদেহ যখন মসজিদের পাশের পারিবারিক নতুন কবরস্থানে দাফন করার জন্য নেয়া হয়, সে সময় পুকুরপাড়ে মেয়ে-পুত্রবধূসহ ও ননদকে নিয়ে সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন ফরহাত কাদের।

এ সময় সাকার মরদেহের দিকে তাকিয়ে সাকাপত্নী বলেন, ‘তার শরীর-চেহারায় কোনো পরিবর্তন হয়নি গত কয়েকদিনে। এর আগে যেমন দেখে আসছিলাম কালকেও সেরকম দেখলাম। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন।’

এরপর মা-মেয়ে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে বায়তুল বিলালে চলে যান। এর আগে সকাল পৌনে ৯টার দিকে ছোট ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীসহ ৯টি গাড়ির বহর নিয়ে ঢাকা থেকে রওনা দেন ফরহাত কাদের চৌধুরী। তারও আগে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বড় ছেলে ফাইয়াজ কাদের চৌধুরী ও তার স্ত্রী দীনিয়া খন্দকার একই গাড়িতে চড়ে প্রথম ঢাকা থেকে গহিরায় আসেন। তবে গাড়ি থেকে নেমে হুম্মাম কাদের চৌধুরী ও ফাইয়াজ কাদের চৌধুরী নিকটাত্মীয়দের জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করলেও একেবারেই নির্বাক ছিলেন সাকাপত্নী ফরহাত কাদের চৌধুরী।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর অ্যাম্বুলেন্সে করে সকাল ৯টার দিকে তার মরদেহ চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার তার পৈত্রিক বাড়িতে। সেখানেই বায়তুল বিলালের পারিবারিক কবরস্থানে রোববার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তার দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে সকাল সকাল ৯টা ১০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার মাজহারুল ইসলামের কাছ থেকে সাকার মরদেহ বুঝে নেন তার ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী। এর মিনিট দশেক পরেই সাকার জানাজার নামাজ পড়ানো হয়। হেফাজত ইসলামের সিনিয়র নায়েবে আমির মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী জানাজার নামাজ পড়ান।

এর আগে শনিবার রাত ৩টার পর থেকে সেখানে পুলিশ পাহারায় কবর খোঁড়া শুরু হয়। সাত থেকে আটক জন গোড়খোদক খননের কাজ করেন। তবে দাফনের আগে তার জানাজা নিয়ে শুরু হয় উত্তেজনা। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে গহিরা কলেজ মাঠে জানাজা আয়োজন করতে চায় স্থানীয়রা। তবে প্রশাসনের বাধায় তা বন্ধ হয়ে যায়। পরে তার বাড়ির পাশেই জানাজার নামাজ পড়া হয়।

তবে এ নিয়েও পুলিশের সাথে হুম্মাম কাদের চৌধুরীর মাঝে মিনিট দশেক ধরে দেনদরবার চলে। অবশেষে ‘উপরের’ একটি ফোনে সাকার দাদার বাড়ির সামনে থেকে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে জানাজা পড়াতে সম্মত হয় পুলিশ। সেখানে জানাজা সম্পন্ন শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মেজ ভাই সাইফুদ্দীন কাদের চৌধুরীর পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

এদিকে যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মরদেহ প্রতিরোধে রাউজান উপজেলার প্রবেশপথসহ বিভিন্ন পয়েন্টে মধ্যরাত পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিলেও পরে পুলিশের তৎপরতায় তারা সরে যায়। তবে দাফন শেষে জানাজায় অংশগ্রহণকারীদের ‘ছাত্রলীগের’ নেতাকর্মীরা পথে পথে বাধা দিয়েছে। তাদের হামলার শিকার হয়েছেন একটি বেসরকারি টেলিভিশনের একজন রিপোর্টারসহ আরো তিনজন।

কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে থাকা টিম জানিয়েছে, শনিবার রাত ২টা ৫৩ মিনিটে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে আসে সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স। এর আগে রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়।

সাকা চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরপরই সাকার মরদেহ পরিবহন অবাধ করতে রাত সাড়ে ১০টার পর থেকে চট্টগ্রামের অক্সিজেন থেকে হাটহাজারী হয়ে রাউজান পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক র‌্যাব-পুলিশ ও বিজিবি মোতায়ন করা হয়। সাকার মরদেহ যাতে কোনো বাধার মুখে না পড়ে সেজন্য সড়কে কাউকে অবস্থান করতে দেয়া হবে না বলেও আগে থেকেই জানিয়ে দেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এ কে এম হাফিজ আক্তার।

১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সাকা চৌধুরীকে ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। পরে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেন সাকা চৌধুরী। আপিলের রায়ে তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। আপিল বিভাগের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। এর ১৪ দিনের মাথায় ওই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেন সাকা চৌধুরী।

২০ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন চেম্বার আদালত ওই আবেদন শুনানির জন্য ২ নভেম্বর দিন নির্ধারণ করেছিলেন। পরে সাকা চৌধুরীর আইনজীবীর সময়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানির তারিখ ১৭ নভেম্বর পুনর্র্নিধারণ করেন আপিল বিভাগ। কিন্তু সাকা চৌধুরীর আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি একদিন পিছিয়ে দেন আদালত।

১৮ নভেম্বর বুধবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দেন। ফলে চূড়ান্ত আদেশেও তার ফাঁসি বহাল থাকে। ফাঁসির রায় বহাল থাকায় সাকা চৌধুরীর সামনে সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ ছিল।

পরে বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ৯টায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সিনিয়র সহকারী জজ আফতাবুজ্জমানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল রায়ের অনুলিপি নিয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছায়। সেদিন রাতেই সাকার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস ও ডা. হাফিজ তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। শুক্রবার সকালে ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন।’

ওইদিন বেলা ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে কোনো এক সময়ে সিনিয়র জেলসুপার জাহাঙ্গীর কবির তার সামনে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে প্রশ্ন রাখেন। এসময় সাকা জানান, তার আইনজীবীর সাথে কথা বলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন। ফলে সকল প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও এই কারণে ওইদিন তার ফাঁসি কার্যকর করা যায়নি।

শনিবার দুইজন ম্যাজিস্ট্রেট কারাগারে সালাউদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রাণভিক্ষার ব্যাপারে জানতে চান। পরে সালাউদ্দিন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। যদিও পরিবার ও তার দল বিষয়টিকে মিথ্যা বলে দাবি করেছে।

প্রাণভিক্ষার সেই আবেদন প্রথম যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতামত দেয়ার পর নথি যায় আইনমন্ত্রীর কাছে। আইনমন্ত্রীও মতামত দেয়ার পর প্রাণভিক্ষার ফাইল নিয়ে যাওয়া হয় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের। রাত ৯টার দিকে আইনসচিব বেরিয়ে আসেন রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে। রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করার পরই শুরু হয় দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া।

ডাকা হয় তার পরিবারের সদস্যদের। রাত রাড়ে ৯টার দিকে মূল ফটক দিয়ে তাদের কারাগারে প্রবেশ করানো হয়। শেষ দেখার পর রাত ১০টা ৫০ মিনিটে তারা কারাগার থেকে বের হয়ে যান।

উল্লেখ্য, ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়ার পর ২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন সাকার আইনজীবীরা। আপিল আবেদনে মোট ১ হাজার ৩২৩ পৃষ্ঠার নথিপত্রে বিভিন্ন ডকুমেন্টসহ ২৭টি গ্রাউন্ড ছিল।বাংলামেইল



মন্তব্য চালু নেই