কানাডার এক মেয়র-এর সাথে এক দুপুর

কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবায় পড়ার সুবাদে অনেক কিছু দেখার জানার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। কিন্তু একজন মেয়র এর সাথে পুরো এক দুপুর কাঁটানো সেটা মোটেও ভাবিনি। সেই দিনটি ছিল আমার কাছে সত্যি স্বপ্নের মতো। আজও আমার সেই দিনটির কথা মনে আছে। আর মনে রাখাটাই স্বাভাবিক। এরকম চান্স সবসময় আসে না। ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবায় পড়ার সময় একটা স্কলারশিপ পাই “মাউন্ট সেন্ট ভিন্সেন্ট ইউনিভার্সিটি” থেকে। আর সাত পাঁচ কিছু না ভেবে হ্যালিফ্যাস্কের উদ্দেশ্যে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই বলে রাখা ভাল যে আমার ভ্রমনের নেশা আর নতুন শহর নিজের মত করে খুঁজে নেওয়া আমার আনন্দময় নেশা। তাই এই সুযোগটিকে আর হাতছাড়া করলাম না। যাই হোক, ভালভাবে হ্যালিফ্যাক্সে পৌঁছানোর পরদিন ইউনিভার্সিটির সকল অফিসিয়াল কাজ সম্পন্ন করলাম। তার ৪ দিন পরেই অরিয়েন্টেশন। অরিয়েন্টেশন এ গিয়ে জানতে পারলাম হ্যালিফ্যান্স এর মেয়র মাইক স্যাভেজ আমাদের সকল ইন্টারন্যাশনাল ছাত্র/ছাত্রীদের অভিনন্দন ও আমন্ত্রন জানিয়েছেন। আর সেই অনুষ্ঠানটির নাম ছিল “International Student Reception in 2015” আর সেই অনুষ্ঠানেই পরিচয় হল হ্যালিফ্যান্সের মেয়র এর সাথে। যিনি ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ডার্ট সাউথ এর এমপি ছিলেন। বর্তমানে ২০১২ সন থেকে হ্যালিফ্যান্সের মেয়র হিসাবে নির্বাচিত রয়েছেন। অমায়িক সুদর্শন হাস্যোজ্জল একজন ভদ্র লোক, বন্ধুসুলভ, ন¤্র, অতিথি পরায়ন। সেই অনুষ্ঠানেই আমার জন্য যে এরকম একটা সুবর্ণ সুযোগ এসে যাবে তা মোটেও ভাবিনি।

অনুষ্ঠানে মেয়র আমার পাস্ট পারফরমেন্স আর রেজাল্ট দেখে খুশি হয়ে আমাকে তাৎক্ষনিক সিলেক্ট করেন। তিনি উপহার হিসেবে তার সাথে এক দুপুরে লাঞ্চ আর ন্যাচারাল মিউজিয়াম এর ১২টি ফ্রি এন্ট্রি পাস দেন। অত:পর অনুষ্ঠানের শেষে মেয়রের সেক্রেটারি এসে আমার ডিটেইল্স ইনফরমেশন নেন এবং বলেন, তোমাকে ই-মেইল করা হবে কখন তোমার সাথে মেয়র লাঞ্চ করবেন। এমনকি তার পারসোনাল বিজসেন/ ভিজিটিং কার্ড আমাকে দেন। যাতে তার বাসার ফোন নাম্বার ছিল।

পরদিন বিকেলে আমি একটি ই-মেইল পাই যাতে লেখা ছিল এবং আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল সামনের সপ্তাহে সোমবার ও বুধবার কবে আমি লাঞ্চে যাব। সামনের সপ্তাহের সোমবার আমার পরীক্ষা থাকার কারনে, আমি বুধবার দুপুর সময়টি বেছে নেই। অবশেষে আমার সেই আকাঙ্খিত আনন্দের দিনটি এসে যায় এবং সকালের ক্লাসটি শেষ করে আমি মেয়রের অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হই। তখন দুপুর বারটা, বেশ মিষ্টি রোদ যেন আমার সাথে খেলা করছে। ঠিক পৌনে একটায় আমি হাজির হলাম মেয়রের অফিসের সামনে। আমার যতদূর মনে হয় আমি মোটেও নারভাস ছিলাম না বরং কনফিডেন্ট ছিলাম। আমার পড়নে ছিল জিন্স প্যান্ট, সাদা শার্ট ও পায়ে কেডস। যতটুকু পারা যায় নিজেকে পরিপাটি রাখার চেষ্টা করেছিলাম। শত হলেও এটি একটি হাই গভার্নমেন্ট অফিস যেখানে সাধারণ মানুষের ঢোকা সম্পূর্ণ ভাবে নিষেধ। প্রধান গেট এ ইনফরম এবং নাম বলার সাথে সাথে ঢুকতে দেওয়া হল। তাতে বুঝলাম ওরা আগেই জানত যে আমার সাথে মেয়রের লাঞ্চ করার এ্যাপয়েন্টম্যান্ট আছে। অবশ্য একটি আইডি কার্ড দেওয়া হল এটিতে লেখা ছিল ভিজিটর। মেয়র শ্যাভেজ আমাকে দেখে খুশি হলেন, দাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন এবং গলায় মালা পড়িয়ে দিলেন। তারপর মেয়র সাহেব আমাকে একটি শোফায় বসতে বললেন। তারপর আমাকে নিয়ে পাশের একটি অডিটোরিয়াম থেকে ঘুরে আসলেন। এরপর আমাকে তার পারসোনাল সেক্রেটারি (পি.এস) সারাহ এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অসম্ভব সুন্দরি সারাহ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একটি মেয়ে। আমি ভেবেছিলাম তার অফিসের মধ্যেই আমরা লাঞ্চ করব, কিন্তু আমরা চারজন প্ল্যান করলাম বাইরের একটি রেস্টুরেন্টে যাওয়ার। আমি একটু অবাক হলাম এত সিকিউরিটি নিয়ে যাব এই লাঞ্চ এর জন্য? সত্যি বলছি, ঐ সময় আমার মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন, অস্বস্তি আর ভয় লাগছিল। অবশেষে আমরা চারজন রাস্তায় বের হলাম কোন সিকিউরিটি ছাড়াই। যা অসম্ভব লাগছিল আমার কাছে, বিস্মিত হয়েছিলাম এক মুহুর্তের জন্য। মেয়র শ্যাভেজ এবং সারাহ কে দেখলাম রাস্তার লোকাল মানুষের সাথে যেভাবে কথা বলছেন আর হ্যান্ডশেক করছেন তাতে বুঝলাম ওরা প্রায়ই বের হয় আর সত্যি Public Figure। আমি তখনই বুঝতে পারলাম, এদেশের সিকিউরিটি শুধু সরকারের প্রতিনিধির জন্যই নয়, প্রত্যেকটি সাধারণ মানুষের জন্য। আর আমি এখন বাংলাদেশে নই যে মেয়রকে দেখার সাথে সাথে পুলিশ তার কর্তব্যে অতি সচেতন হবে। এখানে একজন জন প্রতিনিধি জানে কিভাবে তার জনগনকে রক্ষা করতে হয়, কিভাবে তার সমস্যার কথা জানা যায়, শুধু জানাই নয়, কিভাবে তার সমাধান করা যায়।

আামরা একটি ফাইভ স্টার রেষ্টুরেন্টে বসলাম চার জন। আমাকে জিজ্ঞেস করা হল আমি কি খেতে পছন্দ করি? আমি বুঝতে পারলাম না কি অর্ডার দেওয়া উচিত। অনেকক্ষন চিন্তা করার পর ফিস সুপ অর্ডার দিলাম। যেটা ওদের Special Today তে ছিল। মেয়র অর্ডার দিলেন ফিস ফ্রায়। আর সারাহ ওনার অ্যাসিসটেন্ট শুধু এক কাপ করে স্যুপ আর কপি নিল। আমরা সকলেই লেমন ওয়াটার নিলাম ড্রিংস হিসেবে। দোকানের মালিকও বেশ স্বাভাবিক ছিল মেয়রকে দেখার পর। এতে বুঝলাম উনারা প্রায়ই এখানে লাঞ্চ করেন। অর্ডার নেওয়ার পর এবং খাবার আসা পর্যন্ত আমরা আন্তরিকতার সাথে অনেক গল্প করলাম। মেয়র শ্যাভেজ আমার পরিবার ও দেশ সম্পর্কে অনেক কথা জানতে চাইলেন এবং রাজনৈতিক ব্যপারেও অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করলেন।

আমাদের দেশের পর্যটন কেন্দ্র সম্পর্কে জেনে কক্সবাজার, সুন্দরবন, কুয়াকাটা ও ঢাকাতে আসার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমিও সানন্দে তাকে স্বাগতম জানালাম। আমাদের খাবার আসার পর, আমরা পরম তৃপ্তি সহকারে আমাদের লাঞ্চ খেলাম আর গল্পে মেতে উঠলাম।

অবশেষে একজন সাধারণ কাস্টমার যেভাবে বিল দেয়, ঠিক সেভাবে মি. শ্যাভেজ ও বিল দিলেন। রাস্তায় আসার সময় উনি যেভাবে সবার সাথে করমর্দন ও হাই হ্যালো এবং খোঁজখবর নিলেন তাতে বুঝলাম এদেশের জননেতারা কতটা জনগনের কাছাকাছি আর তারা জনগনের সাথে মিলে মিশে থাকে। ভেবে খুব খারাপ লাগল যে আমাদের দেশের মেয়রদের নির্বাচনের পর তাদের জনগনের কাছাকাছি দেখাই যায় না। আর তারা সিকিউরিটি ছাড়া রাস্তাতেও বের হয় না। যাই হোক আমরা ফিরে আসলাম মেয়র এর অফিসে। অফিসে অনেক গল্প গুজব করে বেশ কিছু দামী উপহার সামগ্রী নিয়ে উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে মেয়রের একটি গাড়ীতে ফ্ল্যাটে ফিরলাম। মেয়রের সাথে এ দিনটি আমার কাছে স্মরনীয় হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতেও আনন্দ দেবে।

বি.দ্র: Michael Savage (Mike Savage) পুরো নাম Michael John Savage. Halifax এর মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন ৬নভেম্বর২০১২। এছাড়া ২০০৮ থেকে ২০১১ সালে এম.পি. ছিলেন Dartmouth, নোভাস্কসিয়া, কানাডা।

 

লেখক :

হাসান নাবিউল হক (অনিক)
B.B.A অনার্স ফাইনাল ইয়ার
মাউন্ট সেন্ট ভিনসেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়
স্কটিয়া, কানাডা



মন্তব্য চালু নেই