কাউন্সিল হবে, দলে গণতন্ত্র আসবে কি?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২০১৫ সাল হরতাল-অবরোধ, পেট্রলবোমা, পাইকারি মামলা-গ্রেপ্তারের পাশাপাশি জঙ্গি হামলার বছর হিসেবে দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপকভাবে আলোচিত ছিল। সেই তুলনায় ২০১৬ সালের সূচনাটি ভালো বলতে হবে। ৫ জানুয়ারিকে আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্র রক্ষা’ এবং বিএনপি ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস হিসেবে পালন করলেও ঢাকায় মাত্র দুই কিলোমিটার দূরত্বে দুই দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছে, যা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রায় দুর্লভ। বছরের শুরুতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রায় সবাই জামিনে মুক্ত হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, এটাও ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে দেশের তিনটি প্রধান দলের কাউন্সিল বা জাতীয় সম্মেলন করার ঘোষণা তাৎপর্যপূর্ণ। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ আগামী ২৮ মার্চ, বিএনপি ১৯ মার্চ, জাতীয় পার্টি ১৬ এপ্রিল জাতীয় কাউন্সিল করার ঘোষণা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ বলেছে, তাদের ২০তম ত্রিবার্ষিক জাতীয় কাউন্সিল ২৮ মার্চ সকাল ১০টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুরু হবে। আওয়ামী লীগের ১৯তম কাউন্সিল হয়েছিল ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর। সোয়া তিন বছরের মাথায় তারা এই কাউন্সিল করতে যাচ্ছে।

বিএনপির সর্বশেষ কাউন্সিল হয় ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় কাউন্সিলে দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটি তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। সেই হিসাবে বিএনপির কমিটি ছয় বছর পার করেছে। দলের মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মারা যাওয়ার পর থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের রাজনীতিতে অনেক ওলটপালট ঘটলেও দলটি আছে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে।

বিএনপি ১৯ মার্চ কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত নিলেও স্থান ঠিক হয়নি। তারা তিনটি বিকল্প জায়গার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করে—সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন ও বঙ্গবন্ধু কনভেনশন সেন্টার। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিষয়ে গণপূর্ত অনুমতি দিলেও ডিএমপির অনুমতি পাওয়া যায়নি। মাঝখানে খবর বের হয়েছিল, বিএনপি বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষ এই খবরে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছে, কোনো রাজনৈতিক দলের কাউন্সিল করার সুযোগ সেখানে নেই। সে ক্ষেত্রে বিএনপির কাউন্সিল নিয়ে কিছুটা শঙ্কা থাকলেও প্রস্তুতি চলছে সমানেই। বিএনপি নেতারা আশা করছেন, কাউন্সিলে সরকার শেষতক বাগড়া বাধাবে না। সাধারণ মানুষও তা-ই চায়। বিরোধী দলের কাউন্সিল হলে সরকারের ক্ষতি নেই। বরং তারা কাউন্সিল করতে পারলে কিংবা করতে না দিলে ফের রাজনীতি উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে।

বাংলাদেশের রাজনীতি এখন অনেকটা কাউন্সিলমুখী। কেবল বড় তিন দলই নয়; এ বছর কাউন্সিল করছে সরকারের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। বছরের শেষ নাগাদ কাউন্সিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও। কিন্তু এসব দলের কাউন্সিলে কি রাজনৈতিক নীতি-কৌশলে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসবে, না এত দিন তারা যেভাবে চলছিল, সেভাবেই চলবে? কাউন্সিল নিয়ে শীর্ষ নেতৃত্ব যাই ভাবুন না কেন, তৃণমূলে বেশ উৎসাহ–উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়। তাঁরা দলের নীতি ও কৌশলেও পরিবর্তন চান।

বড় তিন দলের কাউন্সিলে সভাপতি বা চেয়ারপারসন পদে পরিবর্তনের কথা কেউ ভাবছেন না। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তো বলেই দিয়েছেন, তিনি বেঁচে থাকতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আর কেউ হতে পারবেন না। তিন দলে সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতা-কর্মীরা যেমন মনে করেন সৈয়দ আশরাফের বিকল্প নেই, তেমনি বিএনপির নেতা-কর্মীদের কাছেও মির্জা ফখরুল অ-বিকল্প নেতা। তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান কিংবা সম্পাদকমণ্ডলীতে বেশ পরিবর্তন আসতে পারে। বিএনপির কাউন্সিলে পদ–পদবি নিয়ে ঝড় আসতে পারে তার পূর্বাভাস দেখা গেল ছাত্রদলের কমিটি গঠনে। খালেদা জিয়া ৭৩৬ জনের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করেও ভাঙচুর কিংবা বিক্ষোভ থামাতে পারেননি।

বিএনপি বলছে, দলের চেয়ারপারসন ও জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন হবে। কিন্তু অতীতে বিএনপির কোনো পর্যায়েই নির্বাচন হয়নি; অন্তত কেন্দ্রীয় কমিটিতে। সর্বশেষ ২০০৯ সালের কাউন্সিলে মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ নতুন নেতৃত্ব গঠনের সব ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল খালেদা জিয়ার ওপর। সেই কাউন্সিলে দেওয়া ভাষণে তিনি সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসকে গণতন্ত্রের শত্রু হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু বিএনপির রাজনীতিকে সেই সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদবিরোধী ধারায় নিতে পারেননি। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেছেন, ‘স্থায়ী কমিটির সভায় সর্বসম্মতিক্রমে চেয়ারপারসন নির্বাচনের সঙ্গে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদেও নির্বাচনের লক্ষ্যে দলীয় গঠনতন্ত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর জন্য চেয়ারপারসনকে অনুরোধ করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চেয়ারপারসন দলের গঠনতন্ত্রের ১৯-ক ধারায় সংশোধনী অনুমোদন করেছেন।’ বিএনপিতে স্থায়ী কমিটিই নাকি সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক। তাহলে সেই কমিটি কেন চেয়ারপারসনকে অনুরোধ করবে? তারা কেন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না? খালেদা জিয়া নিজেই যখন এই কমিটির প্রধান।

দলের কট্টরপন্থীরা চাইছিলেন, তারেক রহমানের ক্ষমতা বাড়িয়ে কো-চেয়ারম্যান করা হোক। কিন্তু স্থায়ী কমিটি সে ধরনের কিছু করতে রাজি হয়নি। বিএনপির তারেকবিরোধী গ্রুপ মনে করে, লন্ডনে বসে তাঁর উগ্র কথাবার্তা ও ‘সরকার ফেলে দেওয়ার’ হুংকার দলকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। নেতা-কর্মীদের করেছে বিপর্যস্ত। যদিও তিনি প্রবাসে নিরাপদে আছেন। প্রকাশ্যে না হলেও ঘরোয়া আলোচনায় নেতারা এসব নিয়ে আক্ষেপ করেন।

বিএনপি কাউন্সিলের আগে ৭৪টি সাংগঠনিক জেলা কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিলেও সম্মেলন হয়েছে গুটি কয়েক জেলায়। আওয়ামী লীগে পরিসংখ্যানে এগিয়ে থাকলেও খুব কম জেলায়ই পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পেরেছে। দুই দলেই যেখানে কমিটি, সেখানে মারামারি। সর্বশেষ চাঁদপুরে সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপ চেয়ার ছোড়াছুড়ি করেছে। রাজনীতিতে যখন নীতি–আদর্শের চেয়ে হালুয়া রুটি ভাগাভাগির বিষয়টি বড় হয়ে ওঠে, তখন এসব হওয়াই স্বাভাবিক।

কাউন্সিলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আকার বাড়বে। বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসংখ্যা ৭৩। সেটি দলীয় সভানেত্রীর দেশের ফেরার বছরকে স্মরণীয় রাখতে ৮১ করা হতে পারে। পরিবর্তন আসতে পারে সম্পাদকমণ্ডলী ও সভাপতিমণ্ডলীতে। আর বিএনপির নেত্রী তো জানিয়েই দিয়েছেন, ‘যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা পুরস্কৃত হবেন, যাঁরা করেননি তাঁরা তিরস্কৃত।’ অন্যদিকে কাউন্সিলের আগেই নানা অঘটন ঘটে চলেছে জাতীয় পার্টিতে। ১৬ এপ্রিল জাতীয় কাউন্সিল হওয়ার কথা থাকলেও তিন মাস আগে দলের দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন এনেছেন এরশাদ। জিয়াউদ্দিন বাবলুকে মহাসচিবের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে রুহুল আমিন হাওলাদারকে বসিয়েছেন এবং ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে করেছেন কো-চেয়ারম্যান। দলে তাঁর প্রতিপক্ষ গ্রুপ এই পরিবর্তন মানতে পারেনি। তাদের দাবি, রওশন এরশাদকে এক নম্বর কো-চেয়ারম্যান করতে হবে। তারা এরশাদ আহূত প্রেসিডিয়াম সভা বর্জন করেছে। এরশাদ চাইছেন, কাউন্সিলের আগেই দলীয় তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী সরকার থেকে পদত্যাগ করুন। কিন্তু তিনি নিজে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় বিশেষ দূতের পদ ছাড়েননি। জাতীয় পার্টিতে বর্তমানে যে সংকট চলছে, তা আগামী কাউন্সিলে নিরসন হবে কি না বলা কঠিন। যদিও তাঁর বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলার সময় এখনো আসেনি।

নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিতাড়িত সাবেক স্বৈরাচার গণতান্ত্রিকভাবে দল চালাবেন, সেটি কেউ আশা করে না। কিন্তু সেই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সফল ‘অধিনায়ক’ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলবে না? কেন দলে গণতন্ত্রায়ণ হবে না? নেতাদের দাবি, আওয়ামী লীগের জন্ম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। বিএনপির জন্ম সেনা ছাউনিতে হলেও রাজপথেই এই দলটি বেড়ে উঠেছে। এখনো তারা রাজপথে আছে। তাহলে দলের নীতি–কাঠামোয় কেন গণতন্ত্র অনুসৃত হবে না?

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলেই কার্যত গণতন্ত্র নেই। ১৯৯১ সালের পর থেকে দলগুলোর ক্ষমতা এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও একনায়কসুলভ। দলের মধ্যে গণতন্ত্র কমে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের আইনে আছে, কাউন্সিলের মাধ্যমে সব দলের কমিটি নির্বাচিত হবে। কিন্তু নেতৃত্ব নির্বাচন কেন্দ্রীভূত, পরিবার ও উত্তরাধিকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো: আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে কখনো সভাপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না বরং সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর কাউন্সিলররা অন্যান্য পদে নিয়োগ দেওয়ার অধিকার সভাপতিকে দিয়ে দেন। শুধু যে নেতৃত্বে এক পরিবার তা নয়। সাংসদেরাও পরিবারের সদস্যদের সাংসদ বানাচ্ছেন। একই পরিবারের দুজন দুই দল করেও তাঁদের পরিবার টিকিয়ে রাখছে। ‘রাজনৈতিক দলগুলো নীতি নিয়ে আলোচনা করে না। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের নিয়মানুযায়ী ৩৩ শতাংশ নারী থাকার বাধ্যবাধকতাও দলগুলো মানছে না। বিএনপি ও জাতীয় পার্টিতে মাত্র ১০ শতাংশ নারী রয়েছেন। এসব দলের প্রধানের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে চান না।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাউন্সিল কি এসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারবে? না থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড় বলে সবকিছু আগের মতো চালাবে? একুশ শতকের ডিজিটাল বাংলাদেশ অ্যানালগ রাজনীতি দিয়ে চলতে পারে না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে সাধারণ মানুষ তো বটেই তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা যে আস্থা-বিশ্বাস রাখেন, খুব কম ক্ষেত্রেই তাঁরা তা হেফাজত করতে পারেন। ঢাকায় আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে তীব্র হিংসা ও বিদ্বেষ প্রত্যক্ষ করি, প্রতিদিন একে অপরের বিরুদ্ধে তাঁরা যে বিষোদ্‌গার করে চলেছেন, সেটি তৃণমূলে দেখা যায় না। মত ও পথের বিভেদ সত্ত্বেও তাঁরা মুখ দেখাদেখি বন্ধ করেন না।

দেশবাসীর প্রত্যাশা, নির্ধারিত সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো সুষ্ঠুভাবে কাউন্সিল সম্পন্ন করে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত করবে। কিন্তু সেই নেতৃত্ব দলকে গণতন্ত্রায়ণের পথে নিয়ে যেতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নের জবাবের জন্য হয়তো আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ব্যক্তির অহমিকা, পেশিশক্তির দাপট এবং কালোটাকার আস্ফালন চূর্ণ করে প্রতিটি দলে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক; দলীয় প্রধানের হাতে সর্বময় ক্ষমতা অর্পণের বদলে প্রতিটি স্তরে নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা বাছাই করা হোক—কাউন্সিলের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এটুকুই একান্ত চাওয়া।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।



মন্তব্য চালু নেই