কাউকেই মানে না ছাত্রলীগ!

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ বেপরোয়াই রয়ে গেছে। নেতৃত্ব বদল, সাংগঠনিক শাস্তি, অভিভাবক নেতাদের অনুরোধ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ- এসব কোনো কিছুই বাগে আনতে পারছে না সংগঠনটির বেপথু নেতাকর্মীদের। দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েই চলেছে সংগঠনটি।

এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে মারাত্মকভাবে। ছাত্রলীগের ঘটানো চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন ঘটনায় বারবার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে সরকারকে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শও কানে তুলছে না ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শোকাবহ মাস আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর ৪০তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে এবার ৪০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। অথচ এ শোকের মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যেই কমপক্ষে ১৩টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব ঘটনায় দুই কর্মী নিহত ও শতাধিক আহত হয়। এ ছাড়া আগস্ট মাসে রাজধানীতে চুরির অজুহাত তুলে এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা এবং মাগুরায় মাতৃগর্ভে শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।

সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার এক দিন পরই প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগ নেতাদের সংগঠন থেকে ‘আগাছা’ উপড়ে ফেলতে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু এর দুই দিনের মাথায় গত বৃহস্পতিবার এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় বরিশালে সরকারি বিএম কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে গাছে বেঁধে পিটিয়েছে ছাত্রলীগের কর্মীরা।

ছাত্রলীগের লাগামহীন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের অনেক কেন্দ্রীয় নেতাও। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘শিক্ষকদের ঘটনায় ছাত্রলীগের নাম জড়িয়ে পড়ায় আমরা বিব্রত। আমি মনে করি, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন বলেন, ‘এখন ছাত্রলীগের যে রাজনীতির প্রবণতা চলছে তা দল বা ব্যক্তি কোনো হিসেবেই গ্রহণযোগ্য মনে করি না। এর পরও এগুলো চলছে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েও বন্ধ করা যাচ্ছে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি তার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা হারিয়েছে। এটিকে যদি সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হয়, তবে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ছাত্ররাজনীতি বন্ধ রাখতে হবে। কয়েক বছর ছাত্রসংগঠন বন্ধ রাখার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রসংসদ নির্বাচন দিতে হবে। এরপর ছাত্ররাজনীতি উন্মুক্ত করে দিতে হবে।’

ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও : নিজেদের মধ্যে হানাহানি, শিক্ষকদের ওপর হামলা ছাড়াও ভ্রাতৃপ্রতিম অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপরও চড়াও হচ্ছে ছাত্রলীগ। গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে শেরপুর সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বায়েযীদ হাসান ছাত্রলীগের দুই নেতার বিরুদ্ধে প্রাণনাশের চেষ্টার অভিযোগ আনেন। তিনি অভিযোগ করেন, শেরপুর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল ইসলাম সম্রাট ও কর্মী আব্দুল মতিন বুধবার রাতে মীরগঞ্জ এলাকায় হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালায় তাঁর ওপর। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ২১ আগস্ট এক আলোচনা সভায় যুবলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম খুনের অভিযোগে কালিয়াকৈর পৌর ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ রিয়াদকে বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রিয়াদ রফিকুল হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।

শোকের মাসেও চাঁদাবাজির অভিযোগ : শোকের মাস উপলক্ষে চাঁদাবাজির অভিযোগও আছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। রাজধানীতে চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া রাকিব ও ইব্রাহিম রিমান্ডে অপরাধ স্বীকার করেছেন বলে দাবি করেছে রামপুরা থানার পুলিশ। তবে খিলগাঁও থানার ৩ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি আবু তাহেরের নির্দেশে তাঁরা ওই চাঁদা দাবি করেছেন বলে পুলিশকে জানান। এক দিনের রিমান্ড শেষে দুজনকে গতকাল শুক্রবার আদালতে হাজির করে দেওয়া প্রতিবেদনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রামপুরা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মাজহারুল আমিন এসব কথা উল্লেখ করেছেন।

শিক্ষক লাঞ্ছনায় প্রথমে দায় এড়ানোর চেষ্টা, পরে শাস্তি : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের ওপরও চড়াও হচ্ছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গত ৩০ আগস্ট সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ওই সময় অধ্যাপক ইয়াসমিন হককেও হেনস্তা করা হয়। ইয়াসমিন হক জনপ্রিয় লেখক ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের স্ত্রী। এ ঘটনায় ঘটনাস্থলের পাশে থাকা জাফর ইকবাল তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে ধিক্কার ওঠে।

ওই ঘটনায় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি শুরুতে আগের কমিটির মতোই দায় এড়ানোর চেষ্টা করে। ঘটনার দিন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গণমাধ্যমে বলেন, ‘এতে ছাত্রলীগ জড়িত নয়।’ যদিও হামলাকারীদের মধ্যে সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির একাধিক নেতা ছিলেন। দলীয় সূত্রে জানা যায়, পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাপে হামলায় জড়িত তিন ছাত্রলীগ নেতাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

শোকের মাসে হানাহানি : গত আগস্ট মাসের প্রায় পুরোটা জুড়েই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড দেখা যায়। তারা বিভিন্ন সময়ে নিজেদের মধ্যেও সংঘর্ষে জড়ায়। ২৮ আগস্ট শুক্রবার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বাধীন দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে দুজন গুলিবিদ্ধসহ ছয়জন আহত হয়। ২৫ আগস্ট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিনের সামনে মারামারিতে লিপ্ত হয় ছাত্রলীগের দুই পক্ষ। ওই সময় এক ছাত্রলীগকর্মীর মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। ২৪ আগস্ট সন্ধ্যায় রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষ। এতে বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির দুই নেতাসহ ১০ জন আহত হয়। ২৩ আগস্ট রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ মিলনায়তনে জেলা ছাত্রলীগের আয়োজনে জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা চলাকালে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে পাঁচ নেতাকর্মী আহত হয়। ২২ আগস্ট ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের আয়োজনে জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় নিজেদের মধ্যে মারামারিতে লিপ্ত হয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তখন ঘটনাস্থলে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং দুই মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।

১৯ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি গঠিত হওয়ার পর মাস না পেরোতেই গত মঙ্গলবার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে সাতজন আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে শতাধিক রাউন্ড টিয়ার শেল ও গুলি ছুড়তে হয়।

এর আগে ১২ আগস্ট সিলেটে মদনমোহন কলেজে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে ছাত্রলীগের এক কর্মী ছুরিকাঘাতে নিহত হন। ১০ আগস্ট নোয়াখালীর কবিরহাট সরকারি কলেজে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য তহবিলের টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয় কমপক্ষে ২০ জন।

৮ আগস্ট রাতে বরিশাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সমর্থক গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হয় উভয় পক্ষের পাঁচ কর্মী। ৭ আগস্ট বরিশালের গৌরনদীতে মাদকের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধে ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের হাতে খুন হন রাসেল ব্যাপারী নামের এক কর্মী। একই ঘটনায় রিংকু সরদার নামে আরেক কর্মী মারাত্মক আহত হন। ৬ আগস্ট রাতে ঠাকুরগাঁও জেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন নিয়ে দুই পক্ষের নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে ছাত্রলীগের দুই কর্মী আহত হয়। একই দিন বরিশাল বিএম কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত হয় দুজন। কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ও জিএস সমর্থকদের মধ্যে এ সংঘর্ষ ঘটে।

১ আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমির আলী হলে সিট দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয় চার নেতাকর্মী। পরদিন হল কমিটি স্থগিত ঘোষণা করা হয়।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে ছিনতাইয়ে ছাত্রলীগকর্মী : শোকের মাসে ছিনতাইয়ে জড়িয়েও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ১৬ আগস্ট রাতে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লিমন নামের এক নাট্যকর্মী ও তার বান্ধবীকে আটকায় ছাত্রলীগের কয়েক সন্ত্রাসী। পরে নাট্যকর্মীর বান্ধবীকে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে লিমনের কাছ থেকে ব্যাংকের এটিএম কার্ড ও এর পিন নম্বর নিয়ে টাকা তুলে নেয় ছাত্রলীগের ওই সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মী রাজীব বাড়ৈ এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মী অমিত কুমার দাসকে গ্রেপ্তার করা হয়।

বাগে আনতে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ : বেপরোয়া ছাত্রলীগকে বাগে আনতে অবশেষে কঠোর ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয় সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে। আগস্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ছাত্রলীগের দুই নেতা মারা গেছেন। ১৭ আগস্ট গভীর রাতে রাজধানীর হাজারীবাগ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি আরজু মিয়া এবং মাগুড়ার ছাত্রলীগ নেতা মেহেদী হাসান আজিবর নিহত হন এমন ‘বন্দুকযুদ্ধে’। আরজু মিয়া হাজারীবাগে কিশোর রাজা মিয়া হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। আর আজিবর ছিলেন মাগুড়ায় বহুল আলোচিত মাতৃগর্ভে শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়ার মামলার আসামি।

সন্ত্রাস চাঁদাবাজি খুনোখুনি আগেও ছিল : ছাত্রলীগের বিগত কমিটির মেয়াদের প্রায় পুরোটাজুড়েই নানা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। সে সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এর বাইরে খুনোখুনি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির অসংখ্য ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ দায় এড়িয়ে বলত, এতে ছাত্রলীগের কেউ জড়িত নয়।

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর সকালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বিশ্বজিৎ দাশ নামে এক যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে। ২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে রাব্বী নামের এক শিশু নিহত হয়। ওই দুটি ঘটনা তখন ব্যাপক সমালোচিত হয়। ২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে সুমন রায় নামে এক কর্মী নিহত হন। সে বছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন সংগঠনের কর্মী তাপস সরকার। ওই বছর ১ এপ্রিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হন সাদ ইবনে মমতাজ।

ওই কমিটির মেয়াদের শেষদিকেও বেশ কয়েকজন নিহত হয়। গত ১২ মে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হন একজন। ১৬ এপ্রিল দিনাজপুরে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কোন্দলে নিহত হয় দুই কর্মী।

প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানও উপেক্ষিত : আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অনেক নেতার আশা ছিল, গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের ২৮তম জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ হয়তো নিয়ন্ত্রণে আসবে। আশা ছিল, প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীরা গুরুত্ব সহকারে নেবে।

ছাত্রলীগের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পর গত ২৭ জুলাই নবনির্বাচিত নেতারা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তাদের মানুষের আস্থা অর্জনের দিকে গুরুত্ব দিতে বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এ দেশের ছাত্রদের প্রতি যে মানুষের একটা আস্থা, বিশ্বাস ছিল সেটা আবারও ফিরিয়ে আনতে হবে। আমি কখনো কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেইনি, আর কোনোদিন দেবও না। ভোগের মধ্যে সুখ নয়, ত্যাগের মাধ্যমেই নিজেকে গড়ে তুলতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘নবনির্বাচিত ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে ত্যাগের মনোভাব নিয়ে জনগণের সেবা করতে হবে।’

কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান যে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি তা তাদের গত এক মাসের কর্মকাণ্ড থেকেই স্পষ্ট।

বিশিষ্টজনদের অভিমত : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘সব সময়ই সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে। সরকারে থাকা দল বরাবরই তাদের ছাত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ডের প্রতি নমনীয় থাকে। ছাত্র সংগঠনের অপকর্মের মাত্রা বেড়ে গেলে প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, সরকার সব পক্ষই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এগুলোর কারণ হচ্ছে নেতৃত্বের সংগঠনের প্রতি শৈথিল্যের প্রকাশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভিন্ন অপঘটনার পেছনে নেতৃত্বের যোগাযোগ থাকে।’ তিনি বলেন, ‘কোনো সময়ই সমাজ এগুলো সঠিকভাবে গ্রহণ করে না। সংগঠনকে শক্তিশালী ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হলে এসব কার্যক্রমকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। এসব বিষয়ে যদি মূল দল ব্যবস্থা না নেয় তবে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে এবং একটি সময় এরা মূল দলের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। এর উদাহরণ আমরা স্বাধীনতার আগে আইয়ুব খানের সময়ে এনএসএফ এবং বিএনপি-জামায়াতের সময়ে ছাত্রদল-শিবিরের ক্ষেত্রে দেখেছি।’

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘ছাত্রলীগের এসব কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই কাম্য নয়। যারা এসব করে তারা কোনোভাবেই ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনের সদস্য হতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের নামে যেসব ঘটনা ঘটছে তা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। যারা দায়ী তাদের শুধু সংগঠন থেকে বহিষ্কার নয়, আইনানুগ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের এসব কর্মকাণ্ডের দায় ১৬ আনা সরকারের ওপর বর্তায়।’

‘ছাত্রলীগে কেউ অপরাধ করে পার পাবে না’ : তবে সব ঘটনায় ঢালাওভাবে ছাত্রলীগকে দোষ দেওয়া ঠিক নয় বলে মনে করেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ। তিনি বলেন, ‘অপরাধীদের কোনো দল নেই। তারা বিভিন্ন সময় সুযোগ বুঝে দলের পরিচয় দিয়ে অপকর্ম করে থাকে। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে যেখানেই কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাচ্ছি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি। ছাত্রলীগে কেউ অপরাধ করে পার পাবে না।’



মন্তব্য চালু নেই