কলিরকাল, ছাগল চাটে বাঘের গাল

‘কলিরকাল, ছাগল চাটে বাঘের গাল’ শিরোনামটি পড়ে হয়তো পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এটা আবার কী করে হয়, এটা কি বাস্তবে সম্ভব? প্রথম প্রথম এই প্রবাদটি পড়ে আমার মনেও প্রশ্ন জাগতো, কিন্তু নিত্যদিন ঘটে যাওয়া কিছু কিছু ঘটনার কারণে এখন আর আমার মনে এমন প্রশ্ন জাগে না। বর্তমানে সব অসম্ভবও সম্ভব হচ্ছে। কলির কাল বলে কথা…।

কলির কাল কথাটা সেই অনেক আগ থেকেই মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। সেই ছোটকালে কিছু বৈসাদৃশ্য দেখলেই আমাদের দাদা-দাদী, নানা-নানীরা বলতেন এটা কলির কাল, এমনটা হবেই। কলি যে কি আর তা যে কি কাল এটা হয়তো এখনো আমরা অনেকে সহজে জানি না, বুঝিনা । তবে এই কলির কালের নমুনা কিন্তু আমরা এখন প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি।

কয়েক বছর আগের কথা- সম্ভবত: ২০০৯ সাল, আমি তখন রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে গবেষণার কাজ করি । তখন রাজশাহী মহানগর পুলিশের এক দক্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা ছিলেন এসি মাহফুজুর রহমান। তার সাথে আমার খুব হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। তিনি মাঝে মধ্যেই চমক লাগানো কিছু কিছু ঘটনা উদঘাটন করে আমাদের ডাকতেন। ফলে আমরাও তার ডাকে সহজেই সাড়া দিতাম।

একদিন বেলা ১১টার এসি মাহফুজ আমাদেরকে পুলিশ সদর দপ্তরে ডাকলেন, আমরা কয়েকজন যথারীতি সেখানে হাজির হলাম। এরপর তিনি ৬-৭ বছর বয়সী এক মেয়ে শিশুকে এবং ১৭-১৮ বয়সী এক কিশোরকে আমাদের সামনে হাজির করাে হলো। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মেয়েটির বাবা-মা। এরপর বিবৃত করা হলো এক বিস্ময়কর ঘটনা। সরকারি চাকুরিজীবী মেয়েটির মা-বাবা জানালেন- তাদের মেয়ে স্কুলে ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ে । তারা সকালে মেয়েটিকে স্কুলে দিয়ে কর্মস্থলে চলে যান। স্কুল থেকে ফিরে মেয়েটি একাই বাসায় থাকতো।

ফলে মেয়েটির সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য একটি মোবাইল কিনেন দেন তারা । কিছুদিন যাওয়ার পর দেখা গেল মেয়েটি স্কুল থেকে ফিরে সারাক্ষণ মোবাইলে কারো সাথে কথা বলেন। এতে মানা করলে সে খানা-পিনা, পড়ালেখা ছেড়ে দেয়। বাবা-মার সাথে নানা অভিমান করে মরতে যায়। ফলে বাধ্য হয়েই বাবা মা ওই অজ্ঞাত ছেলেটির সাথে কথা বলতে দেন। কোনো মতেই তারা ছেলেটির সাথে যোগাযোগ বন্ধ করতে পারছিলেন না। অবশেষে তারা পুলিশে অভিযোগ দিতে বাধ্য হন।

মজার ব্যাপার হলো- পুলিশ সদর দপ্তরে গোয়েন্দা কার্যালয়ে যখন ছেলেটিকে চরথাপ্পর দিতে পুলিশ কর্মকর্তা উত্তেজিত হলেন, তখন ওই শিশু মেয়েটি এসি মাহফুজের পায়ে ধরে বলতে থাকলো- ওকে মারবেন না, ওর কোনো দোষ নেই। ওকে আমি ভালবাসি। ওকে মারলে আমি মরে যাবো। এই দৃশ্য দেখে আমরা সবাই হতবাক। মেয়েটির বাবা-মা তো বটেই। পরে সবাই বসে মেয়ের বাবা-মা কে পরামর্শ দেয়া হলো কাউন্সিলিং করে তাদের মেয়েকে স্বাভাবিক করার জন্য। এরপর কী ঘটেছিল তা আমার জানা নেই।

আরেকটি কলির কালের ঘটনা, আমি তখন কলেজে পড়ি- আমাদের এলাকায় শেখ বাজারে বাবার দোকানে দোকানদারি করতো এক ১০ বছর বয়সী এক মেয়ে। পাশে কালভার্ট নির্মানে কাজে নিয়োজিত এক শ্রমিকের সাথে প্রেমে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে অঘটনও ঘটে যায় । পরে তাকে সামাজিকভাবে বিয়ে দেয়া হয়।

শুধু দু-চারটা ঘটনা নয়, আমরা এই সমাজে এখন কত কিছুই না শুনছি, কিছুদিন প্রেমের টানে রিক্সাচালক যুবকের সাথে পালিয়ে যাওয়া ১০ বছর বয়সী এক কিশোরীকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। উদ্ধারের পর পুলিশ জানতে চেয়েছিল তাকে কে অপহরণ করেছে। মেয়েটির সাফ জবাব আমাকে কেউ অপহরণ করেনি, আমি স্বেচ্ছায় রাজিবের সাথে পালিয়ে এসেছি। স্কুলের ৩য় শ্রেণীর ছাত্রীর সাথে স্কুলে রিকশায় আসা-যাওয়ার পথে পরিচয়। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। ৫/৬ মাস চলতে থাকে তাদের অবুঝ ভালবাসা। তারা দুজন দু’জনাকে কাছে পেতে মরিয়া হয়ে উঠে। এরপর ৩য় শ্রেণীর ছাত্রী সাথে ঘর বাধার স্বপ্ন নিয়ে পালিয়ে যায় তারা।

দেশের আনাচে কানাচে এরকম অনেক ঘটনা ঘটছে, এরকম অনেক খবর আমাদের চোখে পড়ে, আবার অনেক ঘটনা ঘটছে যা চোখে পড়ে না। ৩য় আর ৫ম শ্রেনী পড়ুয়া কোন একটা শিশু প্রেমের কি বুঝে এটাই হয়তো আমাদের সবার প্রশ্ন হতে পারে। এখন যদি পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গড়ায় যে ঐ শিশুরা তাদের প্রেমিককে না পেলে বাঁচবে না, আত্মহত্যা করবে ইত্যাদি ইত্যাদি সে ক্ষেত্রে অভিভাবকেরই বা কি করার থাকতে পারে? আইনই বা কি বলে?

এমন পরিস্থিতিতে হয়তো ছেলেকে শাস্তি দেওয়া যাবে অবুঝ শিশুদের এসবে জড়ানোর অপরাধে কিন্তু যেহেতু শিশুরা প্রেমের টানেই প্রেমিকের সাথে চলে যায়, তাই প্রেমিককে না পেলে যদি গলায় দড়ি দেয়, যদি বিষ খায়, তখন এর দায় কে নিবে? এর থেকে উত্তরণের উপায় কি? কেন এমনটা হচ্ছে?

সাম্প্রতিক কিছু সামাজিক বিপর্যয়ের ঘটনা আমাদেরকে হয়তো ভাবিয়ে তুলেছে। তবে স্রোতের বাইরে গিয়ে কথা বলা মুশকিল, কখন জানি স্রোতের বিপরীতে কথা বলতে গিয়ে গণরোষে পড়ে যাই। কেননা, দুইদিন আগে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘মেয়েদের বিয়ের বয়স ন্যূনতম ১৮ এবং ছেলেদের ২১ রাখতে হবে। এটা আমাদের পরিষ্কার দাবি। এ ব্যপারে সরকারের কোনো রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলবে না। অন্যথায় আমাদের প্রতিবাদ আরো সোচ্চর করা হবে। কঠোর আন্দোলনে যেতেও বাধ্য হব।’

সুলতানা কামাল বলেছেন, ১৬ বছরে এখন পর্যন্ত কোনো মেয়ে স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারে না। সেখানে এ আইন বাস্তবায়িত হলে কোনো মেয়ে স্কুল -কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখতে পারবে না।

নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীর বিয়ের বয়স ১৮ বছর থেকে বাড়ানো উচিত। বিয়ের বয়স বাড়ানো হলে বাংলাদেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়েছে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। বিয়ের বয়স ১৬ করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছু না।

গণস্বাক্ষারতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, কাদের স্বার্থে সরকার এ আইন পাস করতে চাচ্ছে, তারা কি তাদের সন্তানদের ১৬ বছরে বিয়ে দেবে। এ আইন করার অর্থ হলো বাল্য বিবাহকে উৎসাহিত করা।

তিনি বলেন, দেশে বিয়ের বয়স ১৮ বছর আইন থাকা সত্ত্বেও ১৫ বছরে অধিকাংশ মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়। সেখানে আইন করে যদি ১৬ বছর করা হয় তাহলে ১৩ বছরে বিয়ে দেয়া হবে।

আমাদের দেশের সমাজবিজ্ঞানীরাও হয়তো এমন কথা বলছেন। প্রচলিত রীতিনীতিও তা বলছে। কিন্তু আমাদের সবার ভাববার সময় এসেছে এই সমাজ, সামাজিক বন্ধন ও সামাজিক আইনকানুন-রীতিনীতি নিয়ে। কেননা, এর সব কিছুই মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য, সামাজিক বন্ধনকে টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আইনকানুন-রীতিনীতি যদি সমাজকে টিকিয়ে না রাখতে পারে, তবে কী হবে? আজকাল যখন দেখি, ১০-১১ বছরের শিশুরাও প্রেম-ভালবাসা করে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যাচ্ছে, তখন সহসাই বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তোলে।আর দাদা-দাদীদের মুখে উচ্চারিত ‘কলিরকাল, ছাগল চাটে বাঘের গাল’ সেই প্রবাদটি যেন আজকাল বাস্তবতা।কেননা, আজকাল রক্ষকরাই হচ্ছেন ভক্ষক, অশিক্ষিতরা হচ্ছেন শিক্ষক, পিতার হাতেই কণ্যা লাঞ্চিত, পুত্রের হাতে পিতা খুন, পিতার হাতে পুত্র খুন , ভাই এর হাতে ভাই, আর , কন্যার হাতে খুন হয় বাবা মা!অর্থাৎ কলিরকাল আজকাল সবই সম্ভব।

তাই আমার আহবান থাকবে- আসুন আমরা সবাই এই সমাজ ও সামাজিক বন্ধনকে নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করি। সেক্ষেত্রে সময়ের বিবর্তনে মানুষ ও সমাজকে নিয়ে নতুনভাবে গবেষণাও হতে পারে। আমাদের সমাজবিজ্ঞানীদের এই সমাজকে নতুনভাবে ভাবতে হবে । প্রয়োজনে নতুনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে প্রচলিত রীতিনীতিকে। যাতে আমরা এই সমাজের শৃঙ্খলা বজায় রেখে সবাই মিলে শান্তিতে বাস করতে পারি।

লেখক: গবেষক ও কলামলেখক। ই-মেইল: [email protected]



মন্তব্য চালু নেই