কলকাতার পতিতালয়ে পাচার হওয়া এক বাংলাদেশী তরুণীর করুণ কাহিনী

পতিতা। শব্দটি সমাজের দেয়া একটি নাম। তাদের আবাসস্থলও চিহ্নিত ‘পতিতাপল্লী’ হিসেবে।

কিন্তু তারাও মানুষ। তাদের মানবিক পরিচিতি আছে।
অন্য সাধারণ মানুষদের মতো তাদেরও আশা-আকাঙ্ক্ষা আনন্দ-বেদনা সবকিছুই আছে।

তবে পতিতার কাজ করার কারণে তাদের খবর খুব বেশি সামনে আসে না। সমাজে তাদের অন্য চোখে দেখা হয়।

ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমস এর পক্ষ থেকে সম্প্রতি খবর নেয়া হয় কলকাতার সোনাগাছির নিষিদ্ধপল্লীর মেয়েদের।

সেখানে কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া এক তরুণীকে। তার কথায় উঠে এসেছে পতিতাদের জীবনের এক করুণ কাহিনী।

মুন্নির (ছদ্ম নাম) যখন ১০ বছর বয়স তখনই বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে কলকাতার সোনাগাছিতে তাকে পাচার করে দেয় এক যুবক।

তারপর থেকে ৫ বছর সেই সোনাগাছিতেই কেটে গেছে মুন্নির। এখন আর বাব-মার কথা মনে নেই তার।

কলকাতায় যেখানে তিনি পতিতার কাজ করেন সেখানকার দালাল নারীকেই মা বলে ডাকেন মুন্নি। তিনি তাকে মেয়ের মতোই ভালোবাসেন।

প্রতি বছর দুর্গাপূজায় শাড়ি কিনে দেন। বর্তমানে মুন্নির বয়স ১৬। তবে তার সঙ্গে যারা রাত কাটাতে যান তাদের কাছে নিজের বয়স ২০ বছর বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বাংলাদেশ থেকে যখন তাকে সোনাগাছিতে পাচার করা হয় তখন এক নারীর কাছে ছিলেন মুন্নি। প্রথমে সুন্দর পোশাক-আশাক আর খাবার-দাবারের বিনিময়ে সহজেই মুন্নির মন জয় করে নিয়েছিলেন ওই নারী।

তবে ওই নারীর উদ্দেশ্য যে ভালো ছিল না তা বুঝতে পারেননি মুন্নি। তৃতীয় দিনে মুন্নিকে আরও ২০ জন মেয়ের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় রাস্তায়।

তখনও মুন্নি বোঝেননি কেন তাকে রাস্তায় দাঁড় করানো হয়েছে। তিনি ভেবেছিলেন হয় তো অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে তাকে।

কিন্তু যখন তিনি বুঝতে পারলেন খদ্দের ধরার জন্য তাকে রাস্তায় দাঁড় করানো হয়েছে তখন পালানোর চেষ্টা করেন।

কিন্তু পালাতে পারেননি। ওই নারীর লোকজন তাকে ধরে ফেলে। পরে একটা অন্ধকার ঘরে বেশ কয়েকদিন বন্দি করে রাখা হয় তাকে। মারধরও করা হয় তাকে।

তবে তার মুখ, বুক ও উরুতে কখনও আঘাত করা হতো না। ওইসব জায়গায় আঘাতের দাগ পড়লে শরীরের বাজারে ‘দাম’ পড়ে যাবে যে তার।

সোনাগাছির অনেকেই আবার নিজেই ঘর ভাড়া নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করেন। দালালের হয়ে কাজ করেন না।

মুন্নি জানায়,বছর দু‌য়েক আগেও প্রতি ক্রেতার কাছ থেকে ঘণ্টা প্রতি হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পেত সে। কিন্তু এখন দালালের নির্দেশে ক্রেতাদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে নেয়।

এর থেকে অর্ধেক আবার দালালকে দিতে হয়।

মুন্নি জানান, বেশিরভাগই আসে কলেজছাত্র। তবে আইনজীবী, রেস্তোরাঁ মালিক, ট্যাক্সিচালক থেকে শুরু করে ছাপোষা মধ্যবিত্ত, এমনকী কিছু বিদেশী পর্যন্ত আসেন তাদের কাছে।

তিনি জানান, ড্রাগ-আসক্তরাও আসেন তাদের কাছে। এক মাদকাসক্ত জোর করে মুন্নির গলায় ঢেলে দিয়েছিল মাদক। অসুস্থ হয়ে বেশ কয়েকদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল মুন্নিকে।

সোনাগাছি থেকে বেরিয়ে আসার স্বপ্ন দেখে কি না মুন্নি? এমন প্রশ্নে স্বপ্নিল হয়ে ওঠে মুন্নির দুই চোখ।

তিনি জানান, বড় হয়ে নার্স হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু আজ সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়। সোনাগাছিতে মুন্নির ‘মা’ তাকে সোনাগাছি থেকে বের হতে দেবে না।

মুন্নিকে মুম্বাইয়ে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে তার।

তাছাড়া সোনাগাছি থেকে বেরিয়ে মুন্নি যাবেই বা কোথায়? এই নির্মম সত্যটা ১৬ বছর বয়সেই বুঝে গিয়েছে মুন্নি যে, সে যাই করুক না কেন,যত টাকাই আয় করুক না কেন,পতিতা বৃত্তির কলংক তার গা থেকে কোনো দিনও ঘুচবে না।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে সে চিরকালই ‘পণ্য’ হয়েই থাকবে। তাহলে এখন কি আর কোনো স্বপ্নই নেই মুন্নির চোখে? আছে। তার ঘরে প্রায়ই এক ট্যাক্সি ড্রাইভার আসেন। তিনি মুন্নিকে বিয়ে করতে চান।

বিয়েতে আপত্তি নেই মুন্নিরও। সেই পুরুষকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে মুন্নি।

মুন্নির কথায়, তিনি যদি কোনোদিন কন্যা সন্তানের মা হন, তাহলে সেই মেয়েকে যেন কিছুতেই মুন্নির মতো আর একটা বিড়ম্বিত জীবন কাটাতে না হয়।



মন্তব্য চালু নেই