মুক্ত মত

কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে শিক্ষামন্ত্রী ও এইচএসসি পরীক্ষা

এসএসসি পরীক্ষার পর এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ। ১ এপ্রিল বুধবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু চলমান বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এদিন পরীক্ষা শুরু হবে কিনা তা নিয়ে এখনও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন প্রায় পৌনে ১১ লাখ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা । যদিও শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘যে কোনো বাধাই আসুক না কেন, আগামী ১ এপ্রিল থেকে রুটিন মাফিক এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা চলবে।’ শিক্ষামন্ত্রীর এমন বক্তব্যেও পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছেন না পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
কেননা, এর আগে ২০ দলীয় জোটের লাগাতর অবরোধ-হরতালে ভেঙ্গে পড়েছিল এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার সময়সূচি। গত শনিবার পর্যন্ত ২০ দলের পক্ষ থেকে হরতালের কর্মসূচি না দেয়ায় ধারণা করা হয়েছিল এবারের এইচএসসি পরীক্ষা নির্ধারিত দিনেই শুরু হবে। কিন্তু রবিবার আবারো ৪৮ ঘণ্টার হরতালের কর্মসূচির ঘোষণা দেয়ায় পরীক্ষা শুরু নিয়ে সন্দেহ-সংশয় আরো ঘণীভূত হয়েছে।একই সাথে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।
এর আগে গত রোববার সচিবালয়ে এইচএসসি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আইন শৃঙ্খলা সংক্রান্ত এক সভা শেষে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ‘যত বাধাই আসুক, বিএনপি-জামায়াত যাই করুক ১ এপ্রিল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।’ আজ সোমবার বিকালে পুনরায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে যথাসময়ে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে একই ধরনের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন শিক্ষামন্ত্রী।
একইসঙ্গে তিনি হরতাল-অবরোধ আহ্বানকারীদের পরীক্ষার রুটিন দেখে কর্মসূচি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যথা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোনো পরীক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্থ কিংবা কোথাও কিছু ঘটলে তারাই (যারা সন্ত্রাস করে পেট্রোল মারে ) দায়ি থাকবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারেও তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয় বরদাস্ত করা হবে না। এবার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে কেউ পার পাবে না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত সন্দেহজনকদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এছাড়া সারা দেশে পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে আলাদা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’ (বাংলামেইল২৪ ডটকম, ৩০ মার্চ, ২০১৫)
এদিকে ২০ দলীয় জোটের ঘোষণা অনুযায়ী সোমবার সকাল থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত অবরোধের পাশাপাশি হরতাল পালিত হবে। তবে নির্বাচনের কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর শুধু হরতালের আওতামুক্ত থাকবে। কিন্তু ২০ দলীয় জোটের সাম্প্রতিক প্রবণতা অনুযায়ী বুধ ও বৃহস্পতিবারও হরতাল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনটি হলে সেক্ষেত্রে আগের নিয়মানুযায়ী পরীক্ষা পিছিয়ে যেতে পারে এমনটিই আশঙ্কা অনেকের। আর আশঙ্কা সত্যি হলে, প্রথম পরীক্ষা হতে পারে আগামী ৩ এপ্রিল শুক্রবার।
তবে বিএনপির পরবর্তী ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত এ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছে না পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। হরতাল বর্ধিত করা হলেও তা মঙ্গলবারের আগে ঘোষণার সম্ভাবনা কম। ২০ দল যদি বুধ ও বৃহস্পতিবারও হরতাল দেয় তবে মঙ্গলবার যে কোনো সময় পরীক্ষা সংক্রান্ত ঘোষণা আসতে পারে।
তবে সোমবার বিকালে সচিবালয়ে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ যতটা জোর দিয়ে ১ এপ্রিল থেকেই এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু করার কথা বলেছেন তাতে, পরীক্ষা যথাসময়েই অনুষ্ঠিত হবার কথা। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি হরতাল-অবরোধ আহ্বানকারীদের পরীক্ষার রুটিন দেখে কর্মসূচি দেয়ার আহবান জানানোয় এ ব্যাপারে কিছুটা সংশয় দেখা দিয়েছে।এমনটিই জানিয়েছেন একাধিক অভিভাবক।
এর আগে অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এসএসসির মতো ফাঁকে ফাঁকে পরীক্ষা নিলে এ পরীক্ষা শেষ হতে দীর্ঘদিন লেগে যাবে। এজন্য শিক্ষামন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে সহযোগিতা চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়কেও চিঠি দেয়া হয়েছে। পরীক্ষার্থী-অভিভাবক, শিক্ষক-কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে সর্বাত্মক সজাগ থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
এছাড়া চলমান হরতাল অবরোধে শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে কী করা যায় এ নিয়েও সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে শিগগিরই একটি বৈঠক করার কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী।
শিক্ষা পরিবারের সকল সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘গত তিন মাসে শিক্ষার অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমে স্থবির হয়ে যাওয়া শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কাজ করুন। কারণ আমাদের সাড়ে পাঁচ কোটি ছাত্রছাত্রী তিন মাস ধরে ক্লাস করতে পারছে না, পরীক্ষা দিতে পারছে না, লেখাপড়া করতে পারছে না। এটি জাতির জন্য বিশাল ক্ষতি। এমনকি বছরের প্রথম দিনে সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে বই বিতরণের দিনে হরতাল দিয়ে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘প্রথম শ্রেণী থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত শিশুকিশোর-যুবাদের মধ্যে ভীতি, অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক সৃষ্টি করে তাদের ওপর যে চাপ ও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তার ফলে নতুন প্রজন্মের আত্মবিশ্বাসে আঘাত হেনেছে। এই প্রজন্মই আগামী ৪০/৫০ বছর ধরে দেশ পরিচালনা করবে। তাদের আত্মবিশ্বাসের এ ক্ষতের কারণে জাতিকে খেসারত দিতে হবে।’
এদিকে এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আগেও শিক্ষামন্ত্রী যথাসময়ে পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু চলমান আন্দোলন আর অভিভাবকদের চাপে তিনি সে ঘোষণায় স্থির থাকতে পারেননি। অন্যদিকে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই তিন দিনের পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়ার কথা জানালেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। আসন্ন ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কারণে আগামী ২৬, ২৭ ও ২৮ এপ্রিলের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করা হবে।
বিরোধী জোটকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ হরতাল না দিতে আবারো আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তার এ আহ্বানে যে বিরোধী জোট সাড়া দেবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। আগেই প্রমাণিত হয়েছে-তার এ আহ্বান বিরোধী জোট আমলে নেয় না। টানা হরতালের কারণে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে ২০১৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার সময়সূচি। শুধুমাত্র শুক্র, শনিবার করেই পরীক্ষা দিতে হচ্ছে প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থীকে।ফলে এবারও এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাসমূহ যে পূর্ব নির্ধারিত রুটিনমাফিন নেয়া সহজ হবে না তা রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সহজে অনুমেয়।
প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতেও শিক্ষামন্ত্রী তৎপর, আগে থেকেই শতভাগ ঢেলে সাজানো হয়েছে প্রশ্নপত্রের ব্যবস্থাপনা। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, কেউ অপরাধ করে আর পার পাবে না। সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনিটরিংয়ের মধ্যে রাখা হয়েছে।
পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস বা ফাঁসের গুজব ছড়ানো, ফেসবুকে প্রশ্নপত্রের নামে হুজুগ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, পাবলিক পরীক্ষা আইন-১৯৮০(সংশোধিত ১৯৯৮)-এর শাস্তির বিধান নিশ্চিত ও ফেসবুকে বিভ্রান্তি ছড়ালে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলাসহ প্রচলিত আইনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর শিক্ষামন্ত্রী ও প্রশাসন।
প্রসঙ্গত বলা যায়, দেশের রাজনৈতিক বৈরী পরিবেশেও চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের (গোপনীয়তা সংরক্ষণ)বিষয়ে আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সফল হয়েছেন। এ জন্য তিনি দেশবাসীর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ পেতে পারেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সেই সাথে তাঁর এই সফলতার ধারা আগামীদিনেও বজায় থাকবে বলে প্রত্যাশা করছি।
কেননা, ইতোপূর্বেও কঠোর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাধি পাবলিক পরীক্ষা থেকে সব ধরনের পরীক্ষায় ছড়িয়েছিল। গত কয়েক বছরে প্রাথমিক সমাপনী থেকে শুরু করে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও একাধিকবার ফাঁস হবার ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ গেল বছরে উচ্চ মাধ্যমিক ও প্রাথমিকের প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে দেশজুড়ে ব্যাপক হৈ-চৈ হয়। প্রশ্ন ফাঁসের প্রতিবাদে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল পত্রিকায় একাধিক কলাম লেখেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি বলে দাবি করেন। শিক্ষামন্ত্রী পত্রিকায় কলাম লেখেও জবাব দেন। পরে প্রশ্ন ফাঁস রোধে করণীয় নিয়ে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে (জুলাই) মন্ত্রণালয়ে সভা করেন। সভার পরামর্শের আলোকেই বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার ব্যাপারে বিদ্যমান আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদিও আইনটি এখনও মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।
বক্তব্যের সাথে কাজের মিল রেখে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় শিক্ষামন্ত্রী ও অন্যান্য সংশ্লিষ্টরা কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন তা দেখতে আমাদেরকে আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারা শতভাগ সফল হোন এমনটিই আমাদের সবার প্রত্যাশা। তবে চলমান বিরোধী জোটের লাগাতর আন্দোলনে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নিয়ে এবার যে শিক্ষামন্ত্রী আরো বেশি কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হয়েছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী এবার কলঙ্কমুক্ত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা উপহার দিতে সক্ষম হবেন বলে প্রত্যাশা করছি।সবশেষে ২০১৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের শুভ কামনা করছি।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক। ই-মেইল: [email protected]

[মতামত একান্তই লেখকের। আওয়ার নিউজ বিডি কোন ভাবেই দায়ী নয়]



মন্তব্য চালু নেই