ঐতিহ্য হারাচ্ছে গর্বের শাটল ট্রেন

সাফাত জামিল শুভ, চবি প্রতিনিধি : পাহাড়ী প্রকৃতির অপরুপ অভয়ারণ্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিননন্দন সৌন্দর্যের অন্যতম অংশ শাটল ট্রেন। দেশের বৃহত্তম এই বিদ্যাপীঠ থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে চলে যাওয়া সাবেক শিক্ষার্থীদের সর্বপ্রথম যে স্মৃতি তাড়া করে ফেরে তা হল- রঙীন শাটল।

বিশ্বের মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব ট্রেন ব্যবস্থা আছে। উল্লেখ্য যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো ইউনিভার্সিটি কয়েকবছর আগে তাদের শাটল ট্রেন সার্ভিস বন্ধ করে দেয়ায় বর্তমানে এর এককভাবে দাবিদার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯৮১ সাল থেকে নিত্যসঙ্গী হিসেবে চির পরিচিতি পাওয়া শাটল ট্রেনকে ঘিরেই রচিত হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার কথকতা।অনেকে শাটল দুটিকে ‘চলন্ত বিশ্ববিদ্যালয়’ বলেন, কেউবা বলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রাণভোমরা’।

চবি ক্যাম্পাসে এই শাটল ট্রেনকে ভিত্তি করেই যাত্রা করে প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতি।বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, চবি শাখার উদ্যোগে শাটল ট্রেনে গড়ে উঠে বগিভিত্তিক বেশ কিছু সংগঠন।

সিক্সটি নাইন,বিজয়,সিএফসি,ভিএক্স,একাকার, কনকর্ড,এপিটাফসহ বিভিন্ন নামে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করত ছাত্রলীগ। শুরুটা সংগঠনের ঐক্যের স্বার্থসংশ্লিষ্ট হলেও পরবর্তীতে বগিভিত্তিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন উপগ্রুপে পরিণত হয়। ফলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে বারবার সংঘর্ষের ফলে সারাবছরই সমালোচিত হত ক্ষমতাসীন দলের ভাতৃপ্রতিম এ ছাত্রসংগঠন। বর্তমান কমিটি ঘোষনার পর ক্যাম্পাসকে অভ্যন্তরীণ কোন্দলমুক্ত করতে কাজ শুরু করে চবি ছাত্রলীগ। গতবছর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের হস্তক্ষেপে বগিভিত্তিক রাজনীতি পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়।

সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে গিয়ে বগিভিত্তিক রাজনীতি বন্ধের সুফল পায় সবাই, তথাপি রঙীন শাটলের ঐতিহ্যে ভাটা পড়ে অনেকাংশে। কারণ মূলত শাটল ট্রেনের মাধ্যমেই গড়ে উঠত চবি’র শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ভিত। নিজেদের মত করে বিভিন্ন রঙে রাঙানো সেই শাটল আজ গতানুগতিক ট্রেনগুলোর মতই বিবর্ণ। ‘রঙহীন’ শাটলে আসা যাওয়ার পথে আগের আমেজ আর নেই। শাটলকে নতুন রূপ দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নেয়া হয়নি তেমন কোন উদ্যোগ।

বর্ণহীন শাটল নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের।”শাটলের পূর্বের রঙীন রূপ ফিরিয়ে না দিলে পরবর্তী নবীন ব্যাচগুলো এর ঐতিহ্য সম্পর্কে কিছুই জানবে না। ফলে তারা বঞ্চিত হবে বিশ্ববিদ্যালয় শাটলের আবেগ-অনুভূতির অন্যতম অংশ থেকে” এমনটিই মন্তব্য করেন চবি ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী কনক। কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী রনি বলেন, “শাটল অন্য ৫-১০টা ট্রেনের মত না।বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক একমাত্র শাটল ট্রেন হিসেবে অবশ্যই এর আকর্ষণীয় ও স্বতন্ত্র রূপ থাকা উচিত।”

তাদের মত অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও আশা করেছিল, প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে সদ্য রাজনীতিমুক্ত শাটল ট্রেনের রূপে থাকবে নতুন চমক। কিন্তু আশাহত হতে হয় শিক্ষার্থীদের।

অথচ প্রশাসনের উদ্যোগেই ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে শাটল ট্রেনকে একটি ভিন্ন দৃষ্টিনন্দন রূপ দেয়া হয়েছিল। তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আবু ইউসুফ এর ইচ্ছায় বিভিন্ন বগিতে নিপুণভাবে ফুঁটে উঠেছিল বাংলাদেশের প্রকৃতি,ভাষা আন্দোলন,মহান মুক্তিযুদ্ধ আর আবহমান সংস্কৃতির রঙীন চিত্রপট। শিক্ষার্থীরা মনে করেন, বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আন্তরিক পদক্ষেপে আবারো রঙীন রূপ ফিরে পেতে পারে গর্বের শাটল,যা হবে দেশ তথা বিশ্বে অনন্য।

ছবি : মাইনুল ইসলাম শিমুল ও তৌকির আহমেদ মাসুদ



মন্তব্য চালু নেই