এমপি জেবুন্নেছার ঘুষ কেলেঙ্কারি ফাঁস!

কলেজে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে অর্ধকোটি টাকার ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) জেবুন্নেছা আফরোজের বিরুদ্ধে। নেতৃত্ব নিয়ে বিভক্ত আওয়ামী লীগের একাংশ এই ঘুষ কেলেঙ্কারি নিয়ে মাঠে নামায় তা বরিশালে ‘টক অব দ্য টাউনে’ পরিণত হয়েছে।

বরিশাল সিটি কলেজের শূন্যপদে সাতজন শিক্ষক নিয়োগে প্রার্থী প্রতি মোটা অংকের অর্থ নিয়ে চূড়ন্ত তালিকা তৈরি করায় যোগ্যপ্রার্থীরা ওই অনিয়মের জন্য এমপি জেবুন্নেছাকেই দোষারোপ করছেন।

তবে বুধবার এই এমপিসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে বরিশাল আদালতে মামলা দায়েরের পরই বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়। পাশাপাশি বিভক্ত আওয়ামী লীগের একাংশ সুযোগ বুঝে এ ইস্যুতে মাঠে নেমে পড়ায় চরম বিব্রত অবস্থায় পড়েছেন এমপি জেবুন্নেছা। যদিও এই অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেছেন, ‘নিয়োগ তো এখনও চূড়ন্ত হয়নি।’

আলোচিত ওই মামলার বাদীরা হলেন- সমাজ কর্ম বিষয় নিয়োগ প্রার্থী বরিশাল নগরীর নাজিরের পুল এলাকার গৌরঙ্গ চন্দ্র কর্মকারের ছেলে জীবেশ কর্মকর জুয়েল, কৃষি বিজ্ঞান বিষয়ক প্রার্থী কাউনিয়া সোবাহান মিয়া, পোল এলাকার আবদুস সাত্তার হাওলাদারের মেয়ে মোসা. শেফালি আক্তার, ইংরেজি বিভাগের প্রার্থী মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার রহমত উল্যার ছেলে মো. নেয়ামত উল্যাহ এবং রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রার্থী ভোলার সদর উপজেলার মৃত আব্দুল কাদেরের ছেলে মো. জামাল মাস্টার।

এদিকে, জেবুন্নেছার অনুসারীরা জানান, পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠলে এমপি জেবুন্নেছা আফরোজ গত বুধবারই বরিশাল ছেড়ে ঢাকায় চলে যান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বরিশাল নগরীর প্রাণকেন্দ্র সদর রোড এলাকার সিটি কলেজে শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশের পরই ক্ষমতাসীন মহলের দুটি অংশ তাদের পছন্দের প্রার্থীদের তালিকা তৈরি করে নিয়োগ কমিটির ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়। সদর আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি জেবুন্নেছা আফরোজ পদাধিকার বলে সংশ্লিষ্ট কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি পদে থাকায় তার বিরোধীরা প্রভাব বিস্তার করেও অগ্রসর হতে পারেনি। শিক্ষা অধিদপ্তরের মহা-পরিচালকের প্রতিনিধি হিসেবে বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের অধ্যক্ষ ওই নিয়োগ কমিটির সভাপতি মনোনীত হওয়ার বদৌলতে অপরাপর সদস্যদের সবাইকে এমপির অনুগত শিক্ষকদের তালিকায় রাখা হয়। পরীক্ষার স্থান হিসেবেও বিএম কলেজকে নির্ধারণ করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, বিএম কলেজের অধ্যক্ষ একেএম ফজলুল হক অত্যন্ত নির্ঝঞ্ঝাট লোক হলেও এমপি জেবুন্নেছার অনুগত। গত ২৭ জুলাই পরীক্ষার আগেই তাদের চূড়ন্ত প্রার্থীদের সঙ্গে দেন-দরবার অনুযায়ী কারো কাছ থেকে সাত লাখ এমনকি ১০ লাখ টাকা করে নেয়া হয়।

খোঁজ-খবর নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে, নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্যে অগ্রভাগে থাকা কেউই বর্তমান চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পাননি। এই অনিয়মের গোটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে বিএম কলেজ শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাইউম হোসেনের বিরুদ্ধে। নিয়ম না থাকলেও নিয়োগ পরীক্ষাকালীন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তিনি নিয়োগ কমিটির রুমেই অবস্থান করেন। এমনকি পরীক্ষার শুরু থেকে শেষ অবাধি আলোচিত এই শিক্ষকই পরীক্ষার্থীদের লিখিত থেকে মৌখিক পরীক্ষাও মনিটরিং করেন। পাশাপাশি নিয়োগ কমিটির সদস্যদের পারিশ্রমিকের টাকাও তিনি নিজ হাতে বণ্টন করেন।

বিষয়টি স্বীকার করলেও কোন ক্ষমতাবলে নিয়োগ কমিটির রুমে অবস্থান করছেন বা ভূমিকা রাখছেন তার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি কাইউম হোসেন। তবে শিক্ষক পরিষদের ওই নেতা দাবি করেন, এমপি জেবুন্নেছার অনুরোধেই তিনি সেখানে অবস্থান করেন। তবে একাধিক শিক্ষক ও নিয়োগ কমিটির বেশ কয়েকজন অভিযোগ করেন, প্রফেসর কাইউম অনেকটা ক্ষমতার বলে সেখানে অবস্থান নেয়ায় কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি।

একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই কাইউম হোসেন বেশ কয়েকজন প্রার্থীকে এমপির রেফারেন্সে চাকরির নিশ্চয়তায় টাকা সংগ্রহ করার তাগিদ দিয়ে রেখেছিলেন। এ কারণে প্রার্থীরাও ছিলেন প্রস্তুত। তবে গত মঙ্গলবার রাতে ফাঁস হয়ে যায় নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়টি। এরপরেই সম্ভব্য নিয়োগ বঞ্চিতরা সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন ও বিভিন্ন মহলে বিষয়টি অভিযোগ আকারে উপস্থাপন করে। এ খবরে জেবুন্নেছা আফরোজের প্রতিদ্বন্দ্বি সাবেক চিফ হুইফ এমপি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ছেলে কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ প্রকাশ্যে না এসে অনেকটা অন্তরালে থেকে বঞ্চিত প্রার্থীদের পক্ষে অবস্থান নেন।

অভিযোগ ওঠে, দলের ভেতরে দ্রুত ঘুষ কেলেঙ্কারির খবর ছড়িয়ে দিয়ে এমপি জেবুন্নেছাকে এক প্রকার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছেন ওই যুবলীগ নেতা। পাশাপাশি সংক্ষুব্ধ ৪ প্রার্থী বরিশাল আদালতে জেবু্ন্নেছা আফরোজসহ নিয়োগ কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৩৩ জনকে বিবাদী করে নিয়োগ জালিয়াতির অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। এ মামলার অগ্রভাগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক এবং বিমএ কলেজ অধ্যক্ষও রয়েছেন। কিন্তু এমপি জেবুন্নেছার বিরুদ্ধে মোট ৫৮ লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়টি আলোচনায় বেশ প্রাধান্য পাচ্ছে।

জানতে চাইলে নিয়োগ নিয়ে অনিয়ম বা আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করে এমপি জেবু্ন্নেছা আফরোজ মুঠোফোনে বলেন, এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি। তাছাড়া নিয়োগ তো চূড়ান্ত হয়নি।’

এমপিকে দেয়ার কথা বলে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রার্থী পটুয়াখালীর বাসিন্দা তহিদুল ইসলামকে ১০ লাখ টাকায় তার নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়েছে আর এ ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করেছেন প্রফেসর কাইউম- এমন অভিযোগ তিনি হেসে উড়িয়ে দেন।

তবে কলেজের নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, গোপন পরিকল্পনার আলোকে বৃহস্পতিবার নিয়োগের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের কথা ছিল। সে তালিকা প্রকাশের অনুমোদন দিয়েছিলেন এমপি জেবুন্নেছা আফরোজ। তবে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠায় তা স্থগিত করা হয়েছে বলে সূত্রটি ধারণা করছে।

এদিকে, নিয়োগ কমিটির প্রধান বিএম কলেজের অধ্যক্ষ একেএম ফজলুল হক অনিয়ম বা অর্থ কেলেঙ্কারির বিষয়টি স্বীকার না করলেও আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন তিনি পরিস্থিতির শিকার।



মন্তব্য চালু নেই