এবার সত্যিকারের মেসিডোনা!

দু’পায়ের জাদুতে বার্সেলোনার হয়ে তিনি যে কীর্তি দেখিয়ে যাচ্ছেন তার তুলনা হয় না। তার জাদু দেখতে চাতক পাখির মতো টেলিভিশনের পর্দায় চেয়ে থাকে কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমী। ফুটবলবোদ্ধাদের অনেকেরই ভাষ্য, বার্সায় তিনি যা করছেন সেটাই তাকে সর্বকালের সেরাদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান করে দেবে। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে অসুবিধা হয়নি এই তিনি কে? লিওনেল মেসি। ব্রাজিল বিশ্বকাপে যাকে নিয়ে স্বপ্ন আঁকছে আর্জেন্টাইনরা। বার্সায় বল নিয়ে মেসি যা করেন গত দুটি বিশ্বকাপ ময়দানে তা টেনে আনতে পারেননি। সাফল্য যার পায়ের নিচে লুটোপুটি খায় সেই মেসিকেই সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হতে হয়েছে বহুবার। ‘মেসি তার সেরাটা বের করেন ক্লাব ফুটবলে, আর্জেন্টিনার হয়ে নয়।’ এমন কড়া সমালোচনার পাশাপাশি নিন্দুকেরা কথা তোলেন তার দেশপ্রেম নিয়েও। নিন্দুকের এমন আগ্রাসী কথাবার্তায় মেসির হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে সেটা জানা গেল স্প্যানিশ পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাতকারে। ‘আমি অনেক কথা শুনেছি। জাতীয় দলের হয়ে খেলতে আগ্রহবোধ করি না। এ জন্য আমি জাতীয় সংগীত গাই না। দেশের জার্সির জন্য আমার কোন অনুভূতি নেই। এসব কথায় আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। অনেকে আমাকে অন্যায়ভাবে আক্রমণ করেছে।’

এটা সত্য যে, ২০০৬ ও ২০১০ বিশ্বকাপে মেসির উপস্থিতি ঠিক মেসিময় ছিল না। বার্সেলোনার পারফরম্যান্সের তুলনায় আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে ছিলেন অনেকটাই নিষ্প্রভ। তাই বলে নিজের সেরাটা নিংড়ে দেনননি সেটা মানতে পারছেন না মেসি। এবার নিন্দুকের জবাবটা তিনি যে বিশ্বকাপ মঞ্চেই দিতে চাইবেন এটা বুঝতে জ্যোতিষী হওয়ার প্রয়োজন নেই। আর আর্জেন্টাইনরাও প্রার্থনা করছেন ক্ষুদে জাদুকর ফিরে আসুক ‘১৯৮৬’। সেবার একটা গড়পড়তা দল নিয়েও একক কৃতিত্বে যে দেশকে বিশ্বকাপ জেতানো যায় কার্যত সেটাই করে দেখিয়েছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পা ও হাতের শিল্পিত কারুকার্য দুটোই ব্যাবহার করেছিলেন এই কিংবদন্তি। বাতাসে ভেসে আসা বলে লাফিয়ে উঠে মাথা ছুঁতে না পেরে হাত দিয়ে বল ঠেলে দিলেন জালে। ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটন এমনকি রেফারি-লাইন্সম্যান কেউই ধরতে পারলেন না ম্যারাডোনার চাতুর্য। যে গোলটি ফুটবল ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে ‘হ্যান্ড অব গড’ নামে। এর ঠিক পরপরই ছয় ইংলিশ ফুটবলারকে কাটিয়ে ম্যারাডোনার দ্বিতীয় গোলটি ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’র খেতাব পেয়ে যায়। পুরো বিশ্বকাপে দুর্দান্ত প্রতাপ ছড়ানো ম্যারাডোনার দলকে কেউ আর রুখতে পারেনি। আর তখন থেকেই আর্জেন্টাইনদের কাছে ম্যারাডোনা ও ফুটবল হয়ে গেছে সমার্থক। শুধু তাই নয়, তাদের কাছে ম্যারাডোনা পরম পূজনীয় ‘ফুটবল ঈশ্বর!’

দুটি বিশ্বকাপ খেলা হয়ে গেছে, মেসি এখনও ম্যারাডোনা হয়ে উঠতে পারেননি। ম্যারাডোনা হতে গেলে যে বিশ্বকাপ ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরতে হয় সেটা মেসির না বোঝার কী আছে। কদিন আগে সেকারণেই কিনা অকপটে বলে দিলেন পেলে-ম্যারাডোনাকে তার হিংসা হয়! হওয়ারই কথা, তারা দু’জনই যে শিল্পিত ফুটবলের প্রতীক। একজন ফুটবলের রাজা, অন্যজন রাজপুত্র। পেলে ব্রাজিলকে তিনবার, ম্যারাডোনা একবার শিরোপা জয়ের স্বাদ দিয়েছে আর্জেন্টিনাকে।

বার্সার হয়ে কি জেতেননি মেসি! তিনিই ফুটবল ইতিহাসে একমাত্র খেলোয়াড় যিনি টানা চারবার ফিফা বর্ষসেরার পুরস্কার জিতেছেন। আরও অনেক প্রথমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মেসির নাম। টানা চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সর্বোচ্চ গোল ও হ্যাট্টিকের (৪টি) রেকর্ড আছে তার। বার্সার হয়ে মেসি ছয়টি লা লিগা, দুটি কোপা ডেল রে, পাঁচটি স্প্যানিয় সুপার কোপা, তিনটি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, দুটি উয়েফা সুপার কাপ ও দুটি ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছেন। ২০১৩ সালে লা লিগায় টানা ১৯টি ম্যাচে গোল করার কৃতিত্ব দেখান। মেসির আগে এমন কীর্তি আর কেউ দেখাতে পারেননি।

২০০৬-০৭ মৌসুমে কোপা ডেল রে’র সেমিফাইনালে ম্যারাডোনার সেই বিখ্যাত ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরির’র কথা মনে করিয়ে দেন মেসি। প্রায় ৬২মি. দুর থেকে গেটাফের ছয় খেলোয়াড়কে কাটিয়ে গোল দিয়েছিলেন, ঠিক যেমনটি করেছিলেন ম্যারাডোনা ২৮ বছর আগে ‘৮৬’র মেক্সিকো বিশ্বকাপে। তখনই সারাবিশ্বের ক্রীড়ামাধ্যম ম্যারাডোনার ছায়া দেখতে পান মেসির মাঝে। আর স্প্যানিশ গণমাধ্যম আরও উপরে তুলে মেসির নাম দিয়ে দেন ‘মেসিডোনা’। ২০১০ বিশ্বকাপের আগে স্বয়ং ম্যারাডোনাও বললেন,‘ এই মেসি ৮৬’র ম্যারাডোনার চেয়েও ভালো।’ কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় মেসি খেললেন ১৯৮২’র ম্যারাডোনার মতো। যেখানে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ছিলেন সাদামাটা। সতীর্থদের গোল করতে সহায়তা করেছেন, নিজে গোল করতে পারেননি একটিও। বার্সায় যেখানে মেসি মানেই গোল, সেখানে তার গোলের দেখা না পাওয়াটা বিস্ময়ই। তাহলে ব্রাজিল বিশ্বকাপেই কি মেসি ম্যারাডোনার ৮৬’ ফিরিয়ে আনবেন?



মন্তব্য চালু নেই