এতদিনে শান্তির ঘুম ঘুমোবেন মুস্তফা কামাল!

মাত্র কয়েক ঘণ্টাও গেল না, ঠিক যা ভাবা হয়েছিল, তাই হল। চোখের একটা পাতাও না কাঁপিয়ে আইসিসির চেয়ারম্যান এন শ্রীনিবাসন জানিয়ে দিলেন চেন্নাই সুপার কিংস দলের সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই!

ক্রিকেট দুনিয়ার সবচেয়ে দামী টুর্নামেন্ট আইপিএলে বেটিং কেলেঙ্কারির জেরে চেন্নাই সুপার কিংস ও রাজস্থান রয়্যালস – এই দুটি দলকেই দুবছরের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে তার কিছুক্ষণ আগেই। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নিযুক্ত একটি কমিটি আজ সেই সঙ্গেই ঘোষণা করেছে, চেন্নাই দলের সঙ্গে যুক্ত গুরুনাথ মেইয়াপ্পান ও রাজস্থান দলের অন্যতম মালিক রাজ কুন্দ্রাও সারাজীবন কোনও ক্রিকেট কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারবেন না। কুন্দ্রা হলেন বলিউড অভিনেত্রী শিল্পা শেঠির স্বামী, এবং এই মেইয়াপ্পন আর কেউ নন, শ্রীনিবাসনেরই জামাতা!

আইপিএলের আট বছরের ইতিহাসে এই টুর্নামেন্টকে ঘিরে বারে বারেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা প্রায় একবাক্যে বলছেন আইপিএলের জন্য এত বড় আঘাত এর আগে কখনও আসেনি। কিন্তু ক্রিকেটের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত প্রশাসক নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন নির্বিকার। তিনি এখন দাবি করছেন চেন্নাই সুপার কিংসের সঙ্গেই তার নাকি কোনও সম্পর্ক নেই। আর সম্ভবত সেটা আইসিসি প্রধানের পদটা টিকিয়ে রাখতেই।

চেন্নাই দলটি আইপিএলের ইতিহাসে সফলতম দল, আর সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিতও। চেন্নাই সুপার কিংসকে ঘিরে যে বেটিং চলছিল, তার পান্ডা ছিলেন গুরুনাথ মেইয়াপ্পান, যিনি আবার বিয়ে করেছেন ভারতীয় বোর্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট এন শ্রীনিবাসনের মেয়েকে। চেন্নাই দলের মালিক ইন্ডিয়া সিমেন্টসের ম্যানেজিং ডিরেক্টরও আবার শ্রীনিবাসন নিজে এবং সুপ্রিম কোর্টের নিযুক্ত কমিটি বলেছে, এই মেইয়াপ্পানই ছিলেন দলের ‘আসল মুখ’।

শ্রীনিবাসনের অবশ্য তাতে কিছু আসে যায় না। এর আগে প্রথম যখন গুরুনাথ মেইয়াপ্পানকে ঘিরে বেটিংয়ের অভিযোগ সামনে এসেছিল তিনি অম্লানবদনে বলেছিলেন ‘ওকে তো আমি চিনিই না’। হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে শ্রীনিবাসনের মেয়ে বাড়ির অমতেই বিয়ে করেছিলেন গুরুনাথকে, আর তাতে শ্রীনির কোনও সায়ও ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে আরও অনেক মেয়ের বাবার মতোই কন্যার পছন্দকেই মেনে নিয়েছিলেন তিনি, আর শ্রীনির বকলমে চেন্নাই দলটাও আসলে চালাতেন মেইয়াপ্পানই। সেই সুবাদেই ধীরে ধীরে বেটিংয়ের পাঁকে তার জড়িয়ে পড়া। এমনকি নিজের দলের খেলা নিয়েও বাজি ধরতে কসুর করেননি তিনি।

আসলে বাণিজ্যিকভাবে দারুণ সফল হলেও স্পট ফিক্সিং, বেটিং থেকে শুরু করে হাওলার মাধ্যমে অর্থ পাচার, দুর্নীতির অভিযোগ কখনওই আইপিএলকে পিছু ছাড়েনি। আইপিএলে এই বেটিংয়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে মুম্বই হাইকোর্টে দায়ের করা একটি জনস্বার্থ মামলার জেরেই আজ সুপ্রিম কোর্ট চেন্নাই ও রাজস্থানের দুটি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে দুবছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

দিল্লিতে ভিড়ে ঠাসা ইন্ডিয়া হ্যাবিট্যাট সেন্টারে সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত কমিটির প্রধান ও দেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি আর এম লোধা আজ ঘোষণা করেন, বেটিং কেলেঙ্কারি চলছে জেনেও নীরব থাকার জন্য ইন্ডিয়া সিমেন্টস সংস্থার মালিকানাধীন চেন্নাই সুপার কিংস ও অপর আর একটি দল রাজস্থান রয়্যালসকে দুবছরের জন্য আইপিএল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে।

জাস্টিস লোধা বলেন, মেইয়াপ্পান শুধু বেটিংই করেননি, ভারতীয় বোর্ড, আইপিএল বা ক্রিকেট সবোরই মর্যাদা ধুলোয় লুটিয়েছেন। প্রায় একই রকম অপরাধে তারা দোষী সাব্যস্ত করেন রাজ কুন্দ্রাকেও এবং দুজনকেই সারা জীবনের জন্য ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত করা হয়।

ক্রিকেট পন্ডিতরা বলছেন, আইপিএলকে নিয়ে এতদিন ধরে যে দুর্নীতির কানাঘুষো শোনা যেত আজকের রায়ে সেটাই প্রমাণিত হল, এবং এর ফলে অবধারিতভাবে আইপিএলের একটা ভাবমূর্তির সঙ্কট হবে। দর্শকরা অনেকেই হয়তো ধরে নেবেন, এখানে অনেক ম্যাচই আসলে পাতানো।

বাণিজ্যিকভাবেও দুবছর চেন্নাই দলের না-থাকাটা এই টুর্নামেন্টের জন্য একটা বিরাট ধাক্কা, কারণ বিরাট সমর্থকের দল নিয়ে চেন্নাই-ই কিন্তু আইপিএলের সফলতম বিজনেস মডেল। চেন্নাইয়ের দর্শকদের দলের জন্য মাতামাতি ভীষণ বিখ্যাত – আর কেউ কেউ তো বলছেন চেন্নাইকে ছাড়া আইপিএল মানে সেটা যেন ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ছাড়া প্রিমিয়ার লীগের মতো ব্যাপার!

তবে আইপিএলের এই চরম দুঃখের দিনেও সবচেয়ে সুখী বোধহয় দুজন মানুষ!

এক, আদিত্য ভার্মা। ইনি বিহার ক্রিকেট সংস্থার সচিব, নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রীনিবাসনের বোর্ডের বিরুদ্ধে জেহাদ চালিয়ে যাচ্ছেন গত বেশ কয়েক বছর ধরে। পকেটে পয়সার জোর নেই, তবু কোর্টে কোর্টে হন্যে হয়ে ঘুরেছেন দিনের পর দিন– শ্রীনির দুর্নীতি ফাঁস করার পণ নিয়ে। দিল্লিতে ভাল হোটেলে থাকারও সঙ্গতি ছিল না কোনও দিন, সুপ্রিম কোর্টে যেতেন অটোরিক্সায় চেপে। আজ চেন্নাই সুপার কিংস অর শ্রীনির জামাইয়ের জারিজুরি ফাঁস হওয়ার পর আদিত্য ভার্মা বলছেন, ভারতীয় বোর্ডের এখন উচিত আইসিসি থেকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে শ্রীনিবাসনের নামটা বাতিল করে দেওয়া। সোজা কথায়, আইসিসি’র প্রধানের পদ থেকে শ্রীনিকে ঘাড়ধাক্কা দেওয়া।

দ্বিতীয়জন আ হ ম মোস্তাফা কামাল। বিশ্বকাপে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচের পর আইসিসি’র বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে আর শ্রীনির সঙ্গে তিক্ত ঝগড়ায় জড়িয়ে কীভাবে তাকে আইসিসি প্রেসিডেন্টের পদ খোয়াতে হয়েছিল সেই স্মৃতি এখনও টাটকা। শ্রীনির বিরুদ্ধে মামলা হয়তো শেষমেশ করেননি, কিন্তু তারপর ভারতে এসে মোস্তাফা কামাল বলেছিলেন, ‘জানেন তো বাংলাদেশে এখন লোকে ‘তুই তো একটা শ্রীনি’ বলে গালাগাল দেয় – মিরজাফর-টাফরও আর বলে না!’

শ্রীনির পরিবারে সুপ্রিম কোর্টের এই কাদালেপা, চেন্নাই দলের দুর্দশা আর আইসিসি প্রধানের পদ বাঁচাতে শ্রীনির মরিয়া চেষ্টা – এসব দেখেশুনে বোধহয় আজ প্রায় চারমাস বাদে মোস্তাফা কামালও শান্তির ঘুম ঘুমোবেন!



মন্তব্য চালু নেই