এক সপ্তাহে স্বাভাবিক ‘হয়নি’ পরিস্থিতি

আওয়ামী লীগ ও সরকারের দায়িত্বে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। তাদের প্রত্যাশিত সপ্তাহের চেয়ে বেশি সময় চলে গেলেও রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ হয়নি। মন্তব্যকারী নেতারা বিষয়টি স্বীকারও করেছেন। তবে তাদের দাবি ‘উন্নতি’ হয়েছে পরিস্থিতির।

পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকার নয়া কৌশলে এগুচ্ছে। গত সপ্তাহে সরকারের মন্ত্রী পর্যায় থেকে প্রয়োজনে ‘গুলি করে’ পরিস্থিতি মোকাবিলার কথা বলা হলেও অচলাবস্থা অবসানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয়তা আরও বাড়ানোসহ জন সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দিতে চায় সরকার।

গত সপ্তাহেরও বেশি সময় আগে থেকে ‘পরিস্থিতি এক সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক’ হয়ে যাওয়ার মন্তব্যকারীদের মধ্যে রয়েছেন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, খাদ্যমন্ত্রী, কামরুল ইসলাম, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ বেশ কয়েকজন নেতা ও সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

তাদের করা মন্তব্যের এক সপ্তাহ পর পরিস্থিতি কি? সে বিষয়ে জানতে কথা হয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে। ‘২১ জানুয়ারি মন্তব্য করেছিলেন এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। বর্তমানে কি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে?’— এমন প্রশ্নের জবাবে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে দ্য রিপোর্টকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘পরিস্থিতি একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেছে তা বলব না। তবে, অনেক উন্নতি হয়েছে। আশা করি, কয়েক দিনের মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থা দেখতে পাবেন।’

খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বললাম আর হয়ে গেল বিষয়টা এ রকম নয়। পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসবে। চিন্তার কিছু নেই।’

সচিবালয়ে বৃহস্পতিবার ‘মহাসড়ক, নৌ ও রেলপথে যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন নিরাপদ-নির্বিঘ্ন করতে’ শীর্ষক এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকও সরকারের নতুন কৌশলের অংশ। বৈঠকে সংশ্লিষ্ট পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের (সড়ক পরিবহন, রেল, নৌপরিবহন, স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার) মন্ত্রীসহ পুলিশ, র‌্যাব, আনসার বাহিনীর প্রধানসহ আইন-শৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট সব বাহিনীর প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে সড়কের প্রায় এক হাজার পয়েন্টে বারো হাজার আনসার মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। শুক্রবার থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। একই সঙ্গে জনসচেনতার মাধ্যমে পরিস্থিতি উন্নয়নের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে এমপি, উপজেলা ও ইউপি চেয়ারম্যান এবং সদস্যদের সহযোগিতার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেবে।

বৈঠক শেষে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, জনগণের মধ্যে ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে সহিংসতার আগুন মোকাবিলা করব।’

গত ৪ জানুয়ারি থেকে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে আছে ঢাকা। এর প্রথম দুই দিনের অবরোধে সরকারের ভূমিকা থাকলেও এরপর থেকে টানা অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। আপাতত বিএনপির টানা অবরোধ স্থগিত করার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানাচ্ছে বিএনপির সূত্রগুলো।

অবরোধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির চলমান আন্দোলনের মধ্যে দুই দফা বিশ্ব ইজতেমার দুই আখেরী মোনাজাতের দিন (১১ ও ১৮ জানুয়ারি) বিএনপির পক্ষ থেকে ঢাকার যে কোনো জায়গায় বড় জমায়েতের ধারণা ছিল সরকারের। বিশেষ এই দুই দিনে সরকার ‘অবরুদ্ধ’ খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়সহ সারা ঢাকায় বিশেষ নিরাপত্তা নেয়। এমন আশঙ্কা প্রশমিত হওয়ার পর খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের অবরুদ্ধ অবস্থা ১৮ জানুয়ারি মধ্যরাতে প্রত্যাহার করে নেয় সরকার।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনো জেলা শহর থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন ঢাকা। সামান্য কিছু গাড়ি পুলিশ প্রহরায় রাজধানীতে আসছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধন করতে গিয়ে নিজে দায় নিবেন বলে, চলমান অবস্থা মোকাবিলায় যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশকে।

বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে, এই প্রচেষ্টা কতটা কাজে দিবে তা নির্ভর করবে নেওয়া কৌশলের ওপর।

সাবেক মন্ত্রী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী  বলেন, ‘দমন-পীড়ন করে সরকার সহিংসতা দমনে মোটেই সফল হয়নি। স্বাভাবিক হয়নি পরিস্থিতি। এখন যদি জন সম্পৃক্ততার বিষয়টি আমলে নিয়ে থাকে সেটা ভাল উদ্যোগ। কিন্তু দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলকে আস্থায় না নিলে এ সব কৌশল কতটা কাজে দিবে তা বলা মুশকিল।’

বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘রাজনৈতিক শূন্যতা’ বলে মন্তব্য করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মুনিরুজ্জামান। তিনি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো রাষ্ট্রের শক্তি প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারের নির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে। এ জন্য রাষ্ট্রের ভেতরে আরেকটা রাষ্ট্র (ডিপ স্টেট) তৈরি হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘গুলি দিয়ে সমস্যা সমাধান করা যায় না। আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে।’ দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই