তেল অপসারণ শুরু

এক ব্যক্তির দিকেই অভিযোগের আঙুল

মংলার পশুর চ্যানেলে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে স্মরণকালের ভয়াবহ নৌ দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত তিনটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। দুর্ঘটনার দিন (৯ ডিসেম্বর) সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর, পরের দিন পূর্ব সুন্দরবন বন বিভাগ এবং তৃতীয় দিন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এসব তদন্ত কমিটি গঠন করে।

এদিকে, দুর্ঘটনার তিন দিনের মাথায় গতকাল বৃহস্পতিবার উদ্ধার করা হয়েছে নিমজ্জিত তেলবাহী জাহাজ ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’। দুর্ঘটনাকবলিত নৌযানটিকে উদ্ধারের পর সুন্দরবনের জয়মনি গোলে এনে রাখা হয়েছে। আর গত বুধবার চট্টগ্রাম থেকে জব্দ করা হয়েছে ওটি সাউদার্ন স্টার-৭কে আঘাতকারী ‘এমটি টোটাল’ নামক জাহাজটিকে। কিন্তু এর আগে একই নদীতে ডুবে যাওয়া অন্য তিনটি জাহাজ এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

তবে, দুর্ঘটনা কবলিত জাহাজ উদ্ধার করা যাক বা না যাক- জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সুন্দরবনের ভেতরে বাণিজ্যিক নৌযান চলাচলের অনুমতি প্রদানকারী অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এবং দুর্ঘটনার শিকার ত্রুটিপূর্ণ নৌযান দুটিকে সার্ভে (ফিটনেস) প্রদানকারী কর্মকর্তাদের এখনো শাস্তির আওতায় আনেনি সরকার।

এদিকে সুন্দরবনে পরিবেশ বিপর্যয়, একের পর এক নৌ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তরা।

জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ও পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন এবং জাতিসংঘ কনভেনশন উপেক্ষা করে সুন্দরবনের ভেতরে বাণিজ্যিক নৌযান চলাচলের অনুমতি দিয়ে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ করেছেন। তার বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ।’

একই দাবি জানিয়ে সিটিজেনস রাইটস মুভমেন্টের মহাসচিব ও বাংলাদেশ যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি তুষার রেহমান বলেছেন, ‘যার স্বেচ্ছাচারিতা ও গোঁয়ার্তুমির কারণে সুন্দরবন আজ বিপন্ন প্রায়, সেই বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান শামসুদ্দোহা খন্দকারের বিরুদ্ধে এখনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় আমরা হতাশ হয়েছি; সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছে। আমি অবিলম্বে তাকে বরখাস্ত ও তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরে অনুরোধ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের বিতর্কিত কর্মকর্তা মুঈনউদ্দিন জুলফিকারের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নৌমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’

সমস্ত দায় বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান পদে শামসুদ্দোহা খন্দকারের ওপর দিয়ে নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্যসচিব আমিনুর রসুল বাবুল বলেন, ‘শামসুদ্দোহা খন্দকার চেয়ারম্যান পদে নিয়োগলাভের পর থেকেই অভ্যন্তরীণ নৌ সেক্টরে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। তিনি একদিকে দেশের নদী-নদীর তীর ইজারার নামে ভূমিদস্যুদের হাতে তুলে দিচ্ছেন, অন্যদিকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌ চলাচলের অনুমতি দিয়ে প্রাকৃতিক এই অনন্য সম্পদকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন। আর সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভেয়ার (প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক) মো. মুঈনউদ্দিন জুলফিকার সারা বছরই ত্রুটিমুক্ত নৌযানের ফিটনেস দিয়ে নৌ-দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা বাড়িয়েই চলেছেন। তাই এসব দায়িত্বহীন কর্মকর্তাদের অবিলম্বে শাস্তির আওতায় আনা উচিৎ।’

 

তেল অপসারণ শুরু

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না পাওয়ায় সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া কালো ফার্নেস তেল অপসারণে কাজ করতে পারছে না কাণ্ডারি-১০। তবে বন বিভাগের উদ্যোগে তেল অপসারণে ১০০ নৌকায় করে স্থানীয় ২০০ শ্রমিক কাজ করছেন।

শনিবার সকাল ৯টা থেকে তেল অপসারণে কাজ শুরু করা হয়।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আমির হোসাইন চৌধুরী জানিয়েছেন, দ্রুত তেল অপসারণে ২০০ শ্রমিক কাজ করছে। আজ সারা দিন কাজ চলবে। পরিবেশ অধিদফতর থেকে কাণ্ডারিকে রাসায়নিক ছিটানোর অনুমতি না দিলে কালও তেল অপসারণে কাজ করানো হতে পারে।

এদিকে আজ দুুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে নৌপরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খানের যাওয়ার কথা রয়েছে।

গতকালই সনাতন পদ্ধতিতে সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া ফার্নেস অয়েল অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। গ্রামবাসী এবং জেলেদের উদ্বুদ্ধ করে শ্যালা নদী থেকে তেল সরাতে কাজ করা হয়।। সীমিত পরিসরে গ্রামবাসী ও জেলেরা ফোম, চটের বস্তা ও কলাপাতা ব্যবহার করে তেল অপসারণ করে।

জোয়ারের সময় খালগুলোতে যেন ফার্নেস অয়েল যেতে না পারে সে জন্য বৃহস্পতিবার ১২টি খালের মুখে নেট দেওয়া হয়।

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান শামসুদ্দোহা খন্দকার এর আগে জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে তিন দিন গ্রামবাসীর সহায়তা নিয়েই তেল সংগ্রহের চেষ্টা করা হবে। পরে রাসায়নিক ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

এদিকে, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হার্বার মাস্টার কে এম আকতারুজ্জামান জানান, ডুবে যাওয়া ট্যাংকারে ছিল প্রায় সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল। কিন্তু কাণ্ডারিতে মাত্র ১০ হাজার লিটার তেলের তেজস্ক্রিয়তা কমানোর মতো রাসায়নিক রয়েছে।

পূর্ব সুন্দরবনের শ্যালা নদীর চাঁদপাই রেঞ্জের মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় ‘ওটি সাউদার্ন স্টার সেভেন’ নামে একটি তেলবাহী ট্যাংকার মঙ্গলবার ভোরে ডুবে যায়। ট্যাংকারটি গোপালগঞ্জের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য খুলনার পদ্মা অয়েল ডিপো থেকে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে যাচ্ছিল। এ ঘটনায় ট্যাংকারের মাস্টার মোকলেসুর রহমান (৫০) নিখোঁজ রয়েছেন।

ওই তেল পানিতে ছড়িয়ে পড়ায় মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। বিশেষ করে, জোয়ারে তেলযুক্ত পানি বনে প্রবেশ করায় গাছের গোড়ায় ও শ্বাসমূলে তেলের আবরণ লেগে যাওয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাসে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। এতে ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে রয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই