এক ছাতার নিচ থেকেই গুলশান ও শোলাকিয়া হামলা!

ঈদের দিন শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা ঘটনার প্রায় আট মাস পেরিয়ে গেছে। ওই হামলায় মদদদাতাদের সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত কোনও স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধীরে ধীরে সামনে আসতে শুরু করেছে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য। রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার সঙ্গে জড়িত জঙ্গিরাই শোলাকিয়ায় হামলা চালায় বলে পুলিশের তদন্তে জানা গেছে। দুটো ঘটনারই হামলাকারীরা একই জায়গায় প্রশিক্ষিত। একই নেতা ও একই মতাদর্শের অনুসারী এবং একই ছাতার নিচে তাদের অবস্থান বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর শোলাকিয়া জঙ্গি হামলার তদন্তেও বেরিয়ে এসেছে, গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া ইউনিয়নের ভূতমারা গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীর নাম। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সাল থেকে সে জেএমবির সঙ্গে জড়িত। সে একাধিক হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি।

শোলাকিয়া হামলায় আটক এক যুবক মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টদের মতে, হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর মতো শোলাকিয়া জঙ্গি হামলার মূল পরিকল্পনাকারীও ছিল রাজীব গান্ধী। তাই গত ৭ ফ্রেব্রুয়ারি শোলাকিয়া জঙ্গি হামলায় দায়েরকৃত মামলায় রাজীব গান্ধীকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে কোর্টে আবেদন করা হয়।

এ ব্যাপারে শোলাকিয়া হামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মুর্শেদ জামান বলেন, ‘কোর্ট শুনানি শেষে যদি আসামিকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখায়, তাহলে হয়তো রাজীব গান্ধীকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে শোলাকিয়া হামলার আরও অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। ডিএনএ রিপোর্টের ভিত্তিতে আরও কিছু তথ্য হয়তো বেরিয়ে আসবে। কিন্তু জঙ্গিরা বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকায়, রিপোর্টটি তৈরিতে সময় নেওয়া হচ্ছে। এই সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম এক জায়গায় সীমাবদ্ধ নয়। তাই সব সন্দেহভাজন আসামি ও নিহতদের আলাদাভাবে ডিএনএ পরীক্ষা করে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে।’

মামলার প্রধান আসামি জাহিদুল হক ওরফে তানিমের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘রিমান্ডে নেওয়ার পর জানা যায়, অনেকদিন ধরেই সে গোপনে এ হামলার মূল ছক তৈরিতে সাহায্য করে এসেছে।’

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কখন, কিভাবে কতজন কোনপথে হামলায় যুক্ত হবে, তার মূল ম্যাপটি তৈরিতে বিশাল ভূমিকা ছিল গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরীর। তার পরিকল্পনাতেই দুটি গ্রুপ প্রশিক্ষণ শেষে দেশের ভিন্ন দুটি জায়গায় নৃশংস হামলা চালিয়েছে। হামলার বেশ ক’দিন আগেই তামিম চৌধুরী কিশোরগঞ্জে অবস্থান করে পুরো হামলার ছক তৈরি করেছিলেন।গত বছরের ২৬ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অভিযান ‘হিট স্ট্রং-২৭’ এ তামিম চৌধুরী এবং তার সহযোগী মানিক ও ইকবাল নিহত হয়।

মুর্শেদ জামান আরও জানান, ‘গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার পান্তাপাড়া গ্রামের হাকিম উদ্দিন আকন্দের ছেলে আনোয়ার হোসেন জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলার আসামি হিসেবে কারাগারে ছিলেন। শোলাকিয়ায় হামলার সময় নিহত জঙ্গি আবীর ও গুলশানের হলি আর্টিজান হামলায় জড়িত জঙ্গিরা গাইবান্ধায় আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে ভাড়া থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। এদিক থেকেও দুই হামলার যোগসূত্রের প্রমাণ মেলে।’

শোলাকিয়া হামলার পর বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে র‌্যাব-১৪ কিশোরগঞ্জ ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার (এএসপি) মো. হাসান মোস্তফা স্বপন বলেন, শোলাকিয়া হামলার ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। এ ঘটনার সঙ্গে হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনাকারীদের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। তারা একই জায়গায় প্রশিক্ষিত,তাদের নেতাও একই। তারা একই মতাদর্শ এবং একটি ছাতার নিচে অবস্থান করে এ হামলা চালায়। তবে কিশোরগঞ্জে আরও কোনও জঙ্গির বিস্তার রয়েছে কিনা তা আমরা সুচারুভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’

শোলাকিয়া হামলায় নিহত এক সন্দেহভাজন জঙ্গিপ্রসঙ্গত, গত ৭ জুলাই ঈদের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদগাহের অদূরে আজিমুদ্দিন স্কুলের পাশে পুলিশের ওপর জঙ্গিরা হামলা চালায়।এ সময় তারা পুলিশের ওপর বোমা হামলা করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়। এতে জহিরুল নামে এক পুলিশ সদস্য মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে তিনি কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে মারা যান। এ ঘটনায় আহত হন আরও ১২ জন। এদের মধ্যে আট জন পুলিশ সদস্য। পরে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনসারউল্লাহ নামে আরেক পুলিশ সদস্য মারা যান। গোলাগুলির সময় শোলাকিয়া এলাকার বাসিন্দা ঝর্ণা রাণী ভৌমিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

এছাড়া পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী বন্দুকযুদ্ধে আবির রহমান নামে এক জঙ্গি নিহত হয়। সে কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার সিরাজুল ইসলামের ছেলে এবং রাজধানী ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ’র ছাত্র ছিল। আট মাস ধরে সে নিখোঁজ ছিল।গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আবু শরিফুল ইসলাম ওরফে শফিউল ইসলাম ওরফে সাইফুল ইসলাম নামে আরেক জঙ্গিকে আটক করে র‌্যাব। তার বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট এলাকায় বলে জানা যায়।সে মাদ্রাসার আলিম শ্রেণির ছাত্র ছিল। পরে চিকিৎসা শেষে কিশোরগঞ্জ নিয়ে আসার পথে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায় সন্ত্রাসীরা র‌্যাব গাড়িতে হামলা চালায়। সেখানে বন্দুকযুদ্ধে সাইফুল ইসলাম নিহত হয়। এসময় একটি ব্যাগের ভেতর থাকা ৩টি গুলি ভর্তি পিস্তল, ৪টি চাপাতি, ৩টি ককটেল, কাটার হাতুরি, ২টি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়।

গত ৯ জুলাই শোলাকিয়ার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আইজিপি এ কে এম শহিদুল হক বলেছিলেন, ‘গুলশানের ঘটনায় যে পাঁচ জনের পরিচয় পেয়েছি, তাদের ছন্দনাম আমাদের কাছে ছিল। পরে শোলাকিয়া হামলার ঘটনায় গ্রেফতারকৃতরা জবানবন্দিতে স্বীকার করেছে যে, গুলশানের ঘটনার সঙ্গেও তাদের সম্পৃক্ততা ছিল।’

শোলাকিয়া এলাকায় পুলিশের ওপর জঙ্গি হামলার তিনদিন পর পাকুন্দিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সামছুদ্দিন বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ৬টি ধারায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার রানীগঞ্জ বাজারের আবুদল হাই এর ছেলে শরীফুল ইসলাম ওরফে শফীউল ইসলাম ওরফে সাইফুল ইসলাম (২২) ও কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিম তারাপাশা এলাকার আব্দুস ছাত্তারের ছেলে জাহিদুল হক ওরফে তানিমকে (২৪) প্রধান আসামি করা হয়। মামলায় অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়।সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন।



মন্তব্য চালু নেই