আদিত্য শাওনের রোমান্টিক ছোটগল্প

একান্ত কাছাকাছি

চাকরীর সুবাদে আমাকে প্রায়ই ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম যেতে হয়। উত্তরা অফিস থেকে কাজ সেরে এয়ারর্পোট ষ্টেশনে প্রায় পৌনে দুই ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি। এদেশেরে ট্রেনের কোন টাইম দেওয়া নেই। নিজের ইচ্ছাধীন তার চালচলন। ষ্টেশনে অন্য দিনের তুলনায় কিছুটা ভিড় কম। ঘড়ির সময় অনুযায়ী ট্রেন পৌছাতে হয়তো আরো বেশ কিছুক্ষন সময় লাগবে। আর সে সুযোগটা কাজে লাগাতেই প্লাটফর্মের চায়ের দোকানে দাঁড়িয়েছি। চারিদিকে ব্যস্ত লোকজনের আনাগোনা। হঠাৎ ছোট একটা ট্রাভেল ব্যগ হাতে একজন বৃদ্ধের সাথে দ্রুতু হেটে আসা একটা মেয়ের দিকে চেয়ে আমার দৃষ্টি থমকে গেছে।

দেখতে অবিকল দিপার মতো গড়ন। দিপাই বোধহয়, লম্বা প্লাটফর্মের বেশ খানিকটা দুর থেকে দেখা চেহারার ছাপটা ততোটা স্পষ্ট নয়। চোখে সানগ্লাস চশমা থাকাতে অনুমান করতে ভয় পাচ্ছি। কি জানি আমিও ঠিক করে মনে করতে পারছি না। আমার মনের তিব্র আকাংখায় বুকে অভিরাম ডুগডুগি পেটাচ্ছে। খাওয়া ভুলে আধ খাওয়া ঠাণ্ডা চায়ের কাপ ওভাবেই ধরে রেখেছি। ওকে ডেকে জিজ্ঞাসা করবো কি করবো না ভাবছি। জিজ্ঞাসা করতে পারলেই ভাল হতো। কিন্তু সে নিজেই এক সময় আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। এ দিকে ওদিকে তাকানোর পর আমার দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে কি যেন খুটিয়ে খুটিয়ে দেখার পর সহসা বলল, কোথায় যাচ্ছো সিমান্ত? হতভম্ব হয়ে গেলাম ভাবিনী এভাবে ওর সাথে দেখা হবে, হাফছেড়ে তাই অবাক শুরে বললাম, কতোদিন পরে তোমার দেখা পেলাম।

সোনালী রোদের আভা জড়ানো মুখাখানী কুঞ্জিত করে দিপা বলল,
দেখা না হোক এটাই কি চেয়েছিলে?
খানিকটা লজ্জা পাওয়ায় নিজের দূর্বলতা কাটাতে বললাম, কোথায় যাচ্ছ? বলল,
এই তো ট্রেনেই যাব।
আমার জন্য এ আরেক বিশ্বয়কর, তোমার সাথে কতদিন পর দেখা তাই না?
মাত্র পাঁচ বছর!
কথাটার মাঝে করুন হেয়ালীর আভাস।

মনে মনে পাঁচটা বছরের হিসাব করলাম। খুব বেশি দিন না হলেও ঘোলাজল অনেক দুর গড়িয়ে প্রমত্তা ভৈরবী বদলীয়েছে তার গতিপথ। ট্রেন আসার এখনো কোন লক্ষন না দেখতে পেয়ে বেশ অসুস্থতা উসখুস করছি। দিপাকে দেখলাম, আগের চেয়ে সে অনেক সুন্দর হয়েছে। অবশ্য নারীরা একেক সময় একেক রকম মোহনীয় রুপে আবির্ভাব হয়। এমন আবেদনময় শারীরিক গঠন ও সৌন্দেয্যের বিকাশের কারনে ওরা আরো রহস্যময়। দিপার কণ্ঠে বেশ ভরাটা অনেকটা ব্যক্তিত্ব পূর্ণ আন্তরিকতার শুর। দিপাকে প্রশ্ন করলাম,

কেমন আছো?
মুখের উপর উড়ে আসা চুল সরাতে সরাতে বলল, আমার কথা তো তুমি সবই জান নতুন করে আর নাইবা বললাম। আমার দিকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিল, আর তুমি?

ওর তিক্ষ দৃষ্টির সে দৃষ্টির মোহময়তা এড়িয়ে আমি বলতে পারলাম না। দিপা, তুমিই তো আমার জীবনের সকল গতি প্রকৃতি বদলে দিয়ে গেছো। আমি ভাবতে পারিনী তোমার বাবা জিদ নিয়ে হুট করে তোমার বিয়ের মতো সিরিয়াস এমন একটা কাণ্ড করে বসবে। আমি বিশ্বাসই করতে পারিনী। কিন্তু যখন সব সত্তি বলে জানলাম তখন আর কিছুই করার ছিলনা। চাকরী নামক যাতাকলে পড়ে নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে ইতিমধ্যে পাঁচটা বছর কবে ঝরে গেছে বুঝতেই পারিনি। আমি সে মহুর্তে ভাবনার অনেক গভিরে তলিয়ে গেছি। তখন আমার বয়স ছয় কি সাত মাস বলতে পারিনা। ছোট বেলায় বাবা মা দুজনেই রোড এ্যাক্সিডেণ্টে মারা যাবার পর থেকে আমি নানা বাড়ীতে মানুষ হই। নানা মামা সবাই থাকলেও মূলত ছোট খালাই আমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করে। ছোট খালা রাজবাড়ী স্থানীয় কলেজ থেকে ডিগ্রী দিয়েছে। তার বিয়ের জন্য পাত্রীর খোঁজ চলছে। পাশের গ্রামের আমার মায়ের ছোট বেলার বান্ধবীর মেয়ে হলো এই দিপা। আমরা প্রায় সম বয়সী বলা চলে। খুব লাজুক ছিলাম সব সময় না হলেও তাই মাঝে মাঝে খালার সাথে দিপাদের বাড়ীতে মাস গুনে দু এক দিন যাওয়া পড়তো। সেদিন ছিল শ্রাবনের এক পড়ন্ত বিকেল। কি কাজে যেন হঠাৎই খালার সাথে দিপাদের বাড়ীতে গেলাম। তখন মোটামুটি হলেও কিছুটা বুঝতে শিখেছি সবে ম্যাট্রিক দিয়েছি। যতদুর মনেপড়ে সেই প্রথম দিপাকে আমার ভাললাগা তারপর একটু একটু করে প্রেম।

ছোট খালা আমার বন্ধুর মতো। আমার আর দিপাকে ঘিরে সব কথাই সে জানতো। এর অল্প কিছুদিন পরেই খালার বিয়ে হয়ে যায়। পড়াশোনার জন্য আমি ঢাকা আসি। ঠিক এর সাত বছর পর যখন চাকরীতে যোগ দিয়েছি সে সময় খালার কথা মতো বিয়ের সব কথা পাকাপাকি হওয়ার পরও শেষমেশ সামন্য কথা কাটকাটির কারনে বিয়ে ভেঙ্গে যায়। নির্মম নিয়তির খেলায় অবশেষে দুজন দুই ভূবনের বাসিন্দা।

maxresdefault

খালার সাথে দিপাদের বাড়ীতে যেদিন প্রথম যাই, সেদিন সান বাঁধানো পুকুরের ঠিক মাঝের সিড়িতেই দিপা বসেছিল। সূ্য্য ডুবে যাওয়ার শেষ লাল আভাটুকু জুড়ে ছিল ওর সারামুখ। নাকের ঘমার্ক্ত বিন্দুগুলো মনে হলো পদ্ম কুড়ির শিশির। বপকার্ট চুলগুলো উদাসী দুষ্টমীতে বারবার ঢেকে দিচ্ছে তার মুখাবয়। আমার তখন বাতাসের উপর ভিষন রাগ হচ্ছে। ওদের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চোরা চোখে যদিওবা তাকে দেখছি বাতাস যেন পাল্লা দিয়ে অনেকটা হিংসা করেই দিপার মুখটা আড়াল করতে চাইছে।

বারন্দায় বসে দিপার দাদুর সাথে অনেকটা আনমনে ভিন্ন প্রসংঙ্গের এক গল্প শুরু করলাম। আমি যতই গল্প করি না কেন আমার উদ্দেশ্য একটাই দিপাকে ভাল করে দেখা। চোখে এবং মনের তীব্র অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু হলো দিপার ঐ চোখমুখ। দুরন্ত চঞ্চল কিশোরীর উচ্ছলতা তখনও থামেনি। কিছুক্ষন পর দিপা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো ভাবলাম, ও নিশ্চই জানে না আমি ক্ষনিক দেখার মাঝে কত বিশ্বয় সঞ্চয় করে নিয়েছি।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় ফিরে আসতে চাইলাম। দিপার দাদুর আন্তরীকতায় মুগ্ধ হয়ে শেষ বারের মতো দিপার দিকে চাইলাম। সরাসরি চোখের দিকে চোখ পড়লো তবু কিছু না বলে একটা হাসি দিয়ে চলে এলাম। শেষ দৃষ্টি বিনিময়ে যা নিয়ে এলাম আর যা দিয়ে এলাম তারই খানিকটা হিসাব মেলাতে চেষ্টা করলাম আজ এ ক্ষনিক দেখায়।

প্লাটফর্মে ট্রেন আসার ঘন্টা ধ্বনি। গুটিগুটি পায়ে ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে। দিপা আমার কম্পামেন্টেই উঠলো। ঝকঝক আওয়াজে আমার ট্রেন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। আমি সরাসরি ওর মুখের দিকে না তাকিয়ে জানালার বাইরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। তুমি এখন কোথায় যাবে? দিপার প্রশ্নে আমার ভাবনায় ছেঁদ পড়লো মাথা নিচু করে বললাম, অফিসের কাজে মীরসরাই যাচ্ছি। ওকে প্রশ্ন করলাম তুমি কেমন আছ, চট্রগ্রাম যাচ্ছো কি?

দিপা শান্ত কন্ঠে বললো, চট্রগ্রাম ছাড়া আর কোথায় যাবো। কথায় কথায় জানালো ওর স্বামী চট্রগ্রাম কোর্টে ওকালতি করে। ও আরো বললো, বাড়ীতে মার শরীর ভালো ছিলনা তাই দেখতে গিয়েছিলাম। গেদু চাচাকে নিয়ে এখন ফিরছি। দুরে একটি আসনে বসে ছিলেন গেদু চাচা। ওদের বাড়ীর দীর্ঘ দিনের বিশ্বস্থ কাজের লোক, গেদু চাচা বেশ বয়স্ক মানুষ আমাদের কোন কথায় তার কোন আগ্রহ দেখলামনা।

অনেকক্ষন উভয়ই নিরব হয়ে থাকলাম। ঝকঝক আওয়াজে মাঠ ঘাট প্রান্তর পেরিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে। কখনো বুনো কলমি লতার ঝোপ আবার কখনো গুল্মলতা জড়ানো ঝাউবনের ঝাউপাতা, আকাশ মনি গাছের হলুদ ফুল বাতাসের ঝাপটায় কম্পামেন্টের ভেতরে চলে আসছে। পাশে রাখা একটা ছোট টিফিন ক্যারিয়ার থেকে দিপা একটি প্লেটে চালের আটার রুটি মুরগির মাংস আমার হাতে তুলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, খালা কেমন আছেন? বিয়ে ভেঙ্গোর যাওয়ার পর থেকে খালার সাথে আমার তেমন কোন যোগাযোগ নেই, খালাও সংসার নিয়ে নিজের ব্যস্ততায় দিন কাটাচ্ছে। আমার খোঁজ খুব একটা রাখেনা বললে চলে। তবু তার শরীর ভাল বলেই ওকে জানালাম। দিপা এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, একটা কথা বলবো, তুমি কি কিছু মনে করবে? আজ অবশ্য এসব কথা বলে কোন লাভ নেই। তবুও অনেকদিন অপেক্ষা করে আছি কথাটা জানার জন্য। বললাম,

বল কি জানতে চাও? ও বললো, খালা বাবার উপর রাগ করেছিলেন সেই সাথে আমার ওপরও কি তার রাগ রয়েছে? আমি জবাব দিলাম, তোমার উপর তার রাগ থাকার কথা তো নয়।

দিপা বললো, আমার সব কথা তো তুমি জানতে, আমার দিকটা বিবেচনা করে তো তুমি খালাকে বোঝাতে পারতে। নাকি তুমিও বাবার উপর ক্ষেপেছিলে বলে আমার ব্যপারটা তোমার কাছে গৌন হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষন নীরব থেকে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার চাচাতো ভাই লিটন আমাকে জানিয়েছিল তোমার সাথে ওর সম্পর্ক রয়েছে। শুধু তাই না তোমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও রয়েছে। আমি একদিন দিপার সাথে দেখা করতে গেলে লিটন আমাকে যা যা বলেছিল তা সব তাকে খুলে বললাম। এবার দিপা রাগের স্বরে বললো, সেই বেহায়া বেঈমানটার কথাই তুমি বিশ্বাস করেছিলে! কথাটা আমাকে তো একবার জানাতে চেষ্টা করতে পারতে! দু’লাইন লিখে জানাতে পারতে! আমি বললাম,

আমি ভালোবাসার বিষয়টি নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামতে চাইনি বলে পিছিয়ে গেছি। তাছাড়া যখন বিষয়টি খালা তোমার বাবাকে জানায় তোমার বাবা তখন তর্কতর্কির এক পর্য়ায়ে সন্দেহ, নিচু জাত ইত্যাদি বলে খালাকে প্রচণ্ড অপমান করে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়। খালা মানসিকভাবে বেশ আঘাত পায় প্রচণ্ড ভাবে ভেঙ্গে পড়ে। আমাকে জোর করে কিছু না বললেও তার সন্মান রক্ষার্থে আমিও আর এগুতে পারিনী। কার চোখের দিকে তাকাবো আমি! আমার মা, বাবা আর আপন বলতে তো এই খালাই আমার সব। দিপা বললো, কার কাছে কি শুনলে তা যাচাই বাছাই না করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে? এতো ঠুনকো ছিল তোমার বিশ্বাস, এতো নগ্ন ছিল তোমার ভালোবাসা। ক্রোধ আর লজ্জায় তার চোখে মুখে ছিল আরক্তিম আভা।

দিপা জানালার বাইরে মুখ ঘোরালো ওর চোখ তখন ছলছল করছিল। অনেকক্ষণ কোনো কথা বললো না। পরে আমার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো। আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ও বললো, না আর কিছু বলবো না। তুমি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছ। আসলে আমার আর খেতে ইচ্ছে করছিলনা। লিটনের কথা বিশ্বাস করে যে ভুল করেছি, আজ দিপাকে দেখে আমার ভেতরটা জ্বালে পুড়ে যাচ্ছিল। আবারও দিপা ও আমি অনেকক্ষণ চলন্ত ট্রেনের বাইরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলাম, কেউ কিছু বলছিলামনা। কিছুক্ষণ পর দিপা ভিন্ন প্রসংঙ্গ দিয়ে কথা শুরু করল। বললো, তুমি তো অনেক শুকিয়ে গেছ।

বাইরে থেকে চোখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকালম। হাওয়ায় ওর ফর্সা ভরাট মুখের উপর কয়েক গাছি চুল বারবার এলোমেলো হয়ে উঠছিল। দিপার সেই আগের ডাগর চঞ্চল চোখ আজ অনেক শান্ত ও গভীর বলে মনে হলো। সে চোখ দিয়ে আমার বুকের ভেতরটা ও যেন দেখে নিচ্ছে। আমি ওর প্রশ্নের কোনো জবাব দিলামনা। সে আবার জিজ্ঞাসা করলো, মুখে পক্সের দাগগুলো অবশ্য মিলিয়ে গেছে তবে তোমার সেই আঙুলের ব্যথাটা কি এখনো আছে?

ওর প্রশ্নে অবাক হলাম, সেই কবে পক্সের পর সামান্য সুস্থ হলে এক রাতে মামার সাথে বাজার থেকে ফেরার সমায় মোটর সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে ডান হাতের তর্জুনিতে খুব ব্যথা পেয়েছিলাম এবং দীর্ঘদিন তা আমায় ভুগিয়েছে। দিপা সেদিন খালার সাথে আমাদের বাড়ীতে এসেছিল তখন সেও আমার তর্জুনির শুশ্রুষা করেছিল। এখনো তার সেকথা মনে রয়েছে দেখে আমার বিশ্বয়ের সিমা ছিলনা। আমি বললাম,

তোমার এ কথাও মনে রয়েছে!
দিপা আবার দৃষ্টি জানালার বাইরে ছড়িয়ে দিয়ে বললো,

তুমি যেমন সহজেই সব কথা ভুলে গেছ, আমি তো তা পারিনা। মনে প্রানে একটু একটু করে তোমাকে ভালোবাসার এই প্রতিদান তুমি এভাবে ফিরিয়ে দেবে কোনদিন ভুলেও ভাবিনী। তোমার জোসনা রাতে ভাললাগা সাতটি তারার গল্প। রুপ কথার রাজপুত্র ডালিম কুমারের সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি। নীল পরীর হারানো নোলোক। নিঝুমপরীর রাজকন্যার হারিয়ে যাওয়া রাজকুমারের গল্প, আমি কিছুই ভুলিনী। আচ্ছা তুমি কি সব ভুলে গেছো? প্রশ্নের উত্তরের আশা না করেই বলল, একজনকে সারা জীবনের জন্য সাধানা করলাম আর নিজের শরীরটাকে তুলে দিলাম অন্য আরেক জনকে। যেখানে নিত্য নতুন অভিনয় করে হাসি ফুটিয়ে তুলতে হয়। মানুষের এক জীবনে এতো, বৈচিত্র অভিনয় করে কি বেচে থাকা যায়! বলল, তুমি খুব ভাল। তোমার সরলতা আজও আমাকে প্রচণ্ড জোয়ারের মতো টানে। এ জনমে নাইবা হলে পর জনমে বিধাতা যদি কিছু চাইতে বলে তবে আমি তোমার মতো একজন স্বামী চাইব।

আমি ওর কথার সহজ উত্তর খুজে না পেয়ে চুপ করে রইলাম। দিপা ভিন্ন প্রসংগ নিয়ে আবার কথা শুরু করলো। এভাবে কথপকথনে ফাকে দুজনের সারাটা পথ কেটে গেল। ট্রেন মীরসরাইর কাছাকাছি চলে এসেছিল। মীরসরাই জংসনে এসে এক সময় ট্রেন থামলো। এখানে আমাকে নেমে যেতে হবে। মীরসরাই থেকে ট্রেন দক্ষিণে চট্রগ্রামের দিকে যাবে আর আমি যাবো বিপরীতে হারওয়ালছড়ি। মীরসরাই পৌঁছলে সেখান থেকে পূবে ওহেদপুর হয়ে তারপর শেষে হারওয়ালছড়ি। সেখান থেকে আমার কাজ শুরু। মীরসরাই পৌঁছবার আগেই আমার ছোট ব্যগটা গুছিয়ে নিয়েছিলাম। এবার দিপার কাছ থেকে বিদায় নেবার পালা। দিপা ট্রেনের বাইরে ধাবমান জনপদের দিকে তাকিয়ে ছিল। মাঝে মাঝে লক্ষ্য করছিলাম চোখে ময়লা পড়ার কথা বলে সে চোখ মুছছিল। ওর দীঘল গভীর চোখ লাল হয়ে উঠেছে। আমি ওর হাতে হাতে রেখে বললাম দিপা আমি চলি, এতোটুকু বলে আমি আর কথা বলতে পারছিলাম না। আমার গলা ধরে আসছিল। মাথা নীচু করে ট্রেন থেকে নেমে এলাম। দিপা শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘোমটা ঢেকে শুধু চোখ দুটো বের করে রেখেছে।

প্লাটফার্মের এক কোনে ফুলের দোকান থেকে একটা গোলাপ কুড়ি নিয়ে দৌড়ে ওর হাতে দিলাম। এ যেন দেয়ালে বাঁধানো সেই দি লাষ্ট কিস ছবিটার মতো কাকতালীয় বিপরীত দৃশ্য। ট্রেনের জানালা দিয়ে এক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে। শুভ্র রুমালে বারবার আমার চোখ ঢেকে যাচ্ছে। আমার বুকটা হাহাকার করে উঠলো। এতো ভালোবাসা কোথায় ফেলে আমি উড়োনচণ্ডীর মতো পথে পথে ঘুরে মরেছি। ঝাপসা দুচোখ বারবার বলতে চাইলো, দিপা, আমি এমন এক উদাসী পাগল আর তুমি এই পাগলের জীবনের এক দমকা হাওয়া। ক্ষনে ক্ষনে আচমকা বয়ে যাও, হৃদয় তোলপাড় করে দাও স্মরনের স্মরনীকা হয়ে। এমন কি হয়? শুধু দৃষ্টি বিনিময় তারপর কতদিন দেখা নেই। সিমাহীন পথ চলা। আজ এক্ষনিক দেখায় স্মৃতি গুলো জ্বলে উঠলো বারুদের মতো।

শুনেছি তুমি আমার ছবি দেখতে সবার আড়ালে। সবাইকে বলতে যাই ঘটুক আমি যেন অপেক্ষা করি তোমার জন্য। সেদিনের কিশোরী তুমি আজ অনেক বড় হয়ে গেছ। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে সেই সেদিনের স্মৃতিটাই চির অম্লান, চির ভাস্বর| তোমার অস্ফুট কিশোরী মনে আমিই ছিলাম অনাহুত ধুমকেতু যেন হঠাৎই আসা-যাওয়া।

সমাজ স্বামী সংসার নিয়ে দিপা আজ নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছে। পারিপার্শ্বিকতার সব মিলিয়ে দিপাকে আমার পাওয়া হয়নী। কি জানি! কি সব আবোল তাবল ভাবছি। বহুরুপি মেয়েদের মন নাকি সৃষ্টি কর্তাও বুঝতে পারিনি। হয়তো দিপার আমার কথাই এখন মনেই পড়েনা। আর পড়লেই বা তাতে লাভ কি? সহসা বলি, না পাওয়ার মাঝে থাকে অনেক স্মৃতি-বিস্মৃতি আর পাওয়ার মাঝে থাকে হারানোর ভয়। আমাদের চাওয়া ছিল, পাওয়া এবং না পাওয়ার বেদনা এখানে নেই। অবচেতন মনের ভাললাগা টুকুই রয়েছে আমাদের। সেইতো সম্পদ। তুমি আমায় চাইছো মনে মনে সঙ্গোপনে আর আমি শত ব্যস্ততায় ক্ষনিক থমকে ভেবে নিই তোমার ঐ চঞ্চল মুখখানি। চিকন একটা ব্যথা বুকটার মাঝামাঝি মোচড় দিয়ে উটলো যেখানে তুমি আছ, তোমার স্মৃতি আছে। সেই বুকটার একান্ত কাছাকাছি।

[ আদিত্য শাওনঃ সিঙ্গাপুর প্রবাসী লেখক ও কবি ]



মন্তব্য চালু নেই