একরাম হত্যার সুবিচার প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কা পরিবারের

ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একরামুল হক একরাম হত্যার এক বছর আজ। বীভৎস এ হত্যাকাণ্ডের এক বছর পেরুলেও সুবিচার প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কায় আছেন নিহতের পরিবার ও স্বজনরা।

২০১৪ সালের ২০ মে সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে ফেনী শহরের মিজান রোডস্থ ডায়াবেটিস হাসপাতাল থেকে ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের একটি সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে বের হন একরাম। শহরের বিলাসী সিনেমার কাছে পৌঁছালে প্রথমে একটি ময়লার ট্রলি দিয়ে তাকে বহণকারী প্রাডো গাড়ির গতিরোধ করার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। ট্রলিটি চাপা দিয়ে পার হওয়ার সময় গাড়িটির এক চাকা সড়ক ডিভাইডারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উপরে উঠে যায়। এসময় চতুর্দিক থেকে গুলি ও বোমা ফাটিয়ে দুস্কৃতকারীরা তার গাড়িটি ঘেরাও করে। এ সময় গুলি করে হত্যার পর একরামকে বহণকারী গাড়িতে আগুন ধরিয়ে লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়। বীভৎস এ হত্যাযজ্ঞের ঘটনা দেশ-বিদেশে বেশ আলোচিত হয়।

একরামুল হক একরাম দীর্ঘ সময় ফেনী জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। পরে ফেনী পৌর যুবলীগের সভাপতি ও ২০১১ সালের সম্মেলনে নিজ উপজেলা ফুলগাজী আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ফুলগাজীর আনন্দপুরের নুরুল হক মাষ্টারের ছেলে একরাম। একসময়ে জয়নাল হাজারীর স্টিয়ারিং কমিটির সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন। ১৯৯৭ সালে ফুলগাজীর আনন্দপুর ইউপি নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে জয়নাল হাজারী দেশান্তরী হওয়ার পর ক্রমেই তার সঙ্গ ত্যাগ করে ফেনী আওয়ামী লীগে ভিন্ন মেরুকরণের সূত্রপাত করেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জয়নাল হাজারী দেশে ফিরলেও একরাম ও যুবলীগ নেতা নিজাম হাজারীদের তোপের মুখে দাঁড়াতে পারেননি একসময়ের গুরু জয়নাল হাজারী। ২০০৯ ও ২০১২ সালে পরপর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান হন একরাম। নিজ দলের তো নয়ই ভিন্ন দলের প্রতিদ্বন্দ্বিরাও তার দাপটের কাছে টেকেনি। কিন্তু সেই দলীয় নেতা-কর্মীদের রোষানলের শিকার হয়ে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন একরাম।

হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে আজ। তার কথা মনে উঠতেই গুমরে কেঁদে উঠেন স্ত্রী তাসনিম আক্তার। শহরের মাস্টার পাড়ার বাসায় কথা বলতে চাইলে তাসনিম কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি বলেন, আমাদের খোঁজ এখন আর কেউ নেয় না। মর্মন্তুদ এ হত্যার সুবিচার নিয়ে সংশয় পরিবারের সদস্যদের।

স্ত্রী তাসনিম বলেন, আমরা আল্লাহর কাছে বিচার চাই। ফেনীর আকাশ-বাতাস, বালু কণা সবাই জানে কে এ ধরনের বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পুরো পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি মুহূর্ত আতংকের মধ্যে দিন কাটছে। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সরকার আমাদের নিরাপত্তা দিলে একরামের খুনিদের আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিতে পারব।

নিহত একরামের ছোট্ট শিশু মেয়ে লামিরা জানে না তার বাবা চলে গেছে না ফেরার দেশে। তাসিন ও ফুলও অপেক্ষায় থাকে বাবা ফিরে আসার। বাবার কথা মনে পড়লেই দেয়ালে সাঁটানো ছবির দিকেই ছুটে যায়। কখন বাবা আসবে প্রতিক্ষার প্রহর গুণছে অবুঝ তিন সন্তান। বাবা আসবে না এমনটি বড় সন্তান তাসিন কিছুটা বুঝলেও অন্যরা তা জানে না। বাবার ছবি হাতে নিয়ে চুমু খায়, আদর করে। স্বামীহারা তাসনিমও অবুঝ সন্তানদের নানাভাবে বাবার শূন্যতা বুঝতে না দেয়ার চেষ্টা করেন।

একরাম হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জামিনে বেরিয়েছে ৫ জন। এদের মধ্যে জামিন বাতিলের পর দুইজন পলাতক রয়েছে। মামলায় ৫৪ জনকে অভিযুক্ত করে ২৮ আগস্ট চার্জশিট দাখিল করা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ফেনী মডেল থানার তৎকালীন ওসি (তদন্ত) আবুল কালাম আজাদ। তিনি জানান, ওই ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও গুলি, চুরি, রামদা, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়েছিল। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ১৬ জন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এজাহারভুক্ত আসামি বিএনপি নেতা মাহতাব উদ্দিন আহমদ চৌধুরী মিনার ছাড়া অপরাপরদের সবাই আওয়ামী লীগ ও সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মী। এদের মধ্যে ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক জাহিদ চৌধুরী ও আনন্দপুর ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক বেলাল হোসেন পাটোয়ারীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অন্য গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক জাহাঙ্গীর আদেল, ফেনী পৌর কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহিল মাহমুদ শিবলু, ফেনী পৌর যুবলীগের সদ্য প্রাক্তন যুগ্ম-আহবায়ক জিয়াউল আলম মিস্টার, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লায়লা জেসমিন বড় মনির ছেলে আবিদ রয়েছে।

বুধবার একরামুল হক একরামের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ঘরোয়াভাবে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে তার পরিবার।



মন্তব্য চালু নেই