একটা আশা ছিল, শুনেছিলাম রাসেল বেঁচে আছে

আওয়ামী লীগের জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা। প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যখন কথা বলছেন, তখন স্রোতাদের চোখে অশ্রু। ভেঙে ভেঙে আসছে শেখ হাসিনার গলাও। অনেক কষ্টে আবেগ ধরে রেখে স্মৃতিচারণ করলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। জানালেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর কী দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।

রাজধানীর ফার্মগেটে খামারবাড়ীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এই শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। শেখ হাসিনা জানান, বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিচারে হত্যার পরও ছোট ছেলে শেখ রাসেল বেঁচে আছেন বলে নানা সূত্র থেকে তথ্য পেয়েছিলেন তিনি। পরে ভারতে এসে জানতে পারেন সবার কথা।

বঙ্গবন্ধুতে হত্যার সপ্তাহ দুয়েক আগে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশ গিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব খুন কাঁদছিলেন- জানান শেখ হাসিনা। বলেন, ‘আমি জানি না, যাওয়ার দিক কেন আমার মা সেভাবে কেন কেঁদেছিলেন। মাকে আমি কখনও এভাবে কাঁদতে দেখিনি। আমার মা খুব চাপা স্বভাবের ছিলেন, তিনি কখনও তার অভাব অভিযোগের কথা বলতেন না। যাওয়ার সময় তাকে এভাবে আকুল হয়ে কাঁদতে দেখে বললাম, মা তুমি এভাবে কাঁদলে আমি যাবো না। আমি জানি না, তিনি কিছু বুঝতে পেরেছিলেন কি না।’

শেখ হাসিনা জানান, বঙ্গবন্ধু হত্যার দুই দিন আগে টেলিফোনে শেষ কথা হয় তার মায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সেদিনও তিনি খুব কেঁদেছিলেন। বলেছিলেন তুই আয়, তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে। আর সে কথা হয়নি।’… বলতে বলতে আবার গলা ধরে আসে প্রধানমন্ত্রীর।

রেহানার সে চিঠি আর আসেনি

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা আর্মস্টার্ডামে গেলাম। আব্বাকে জানালাম, কীভাবে তারা উন্নতি করেছে। সেটাই আমাদের শেষ কথা।’ বলেন, ‘আমরা যেখানেই যেতাম আব্বাকে চিঠি লিখতাম। রেহানা সেখান থেকেও একটি চিঠি লিখেছিল, কিন্তু সেই চিঠি আব্বার হাতে আর পৌঁছেনি।’

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিন নেদারল্যান্ডসে ছিলেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। দেশে কিছু একটা হয়েছে-কেবল ভাসাভাসা এ কথা জানতে পেরেছিলেন তিনি। বলেন, ‘আমি তখন দূতাবাসে, একটা ফোন আসলো। আমি ধরলাম, বললো ওয়াজেদ মিয়াকে দেন। তখন শুনলাম ক্যু হয়েছে। তখন আমার মুখ দিয়ে বের হলো, বললাম কেউ কি নেই?’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘টেলিভিশনে তাদের ভাষায় নিউজ হচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম না কি বলছে, কেবল বুঝলাম আব্বা আর নেই, কেউ নেই।’

রাসেল বেঁচে আছেন- জেনেছিলেন শেখ হাসিনা

খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তার ছোট ছেলে শেখ রাসেলকে বাঁচিয়ে রেখেছে- এমন তথ্য ছিল শেখ হাসিনার কাছে। কিন্তু ভারত এসেই তিনি জানতে পারেন, এই তথ্যটি ভুল।

প্রথানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দিল্লি পৌঁছলাম ২৪ আগস্ট। ইন্দিরা গান্ধি বারবার খবর পাঠাচ্ছিলেন। তার সঙ্গে দেখা হলো ৪ সেপ্টেম্বর। ওনার মুখ থেকে শুনলাম কেউ বেঁচে নেই। একটা আশা ছিল, শুনেছিলাম, রাসেল বেঁচে আছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারপর মনে হলো দেশে আসবো। কিন্তু ততক্ষণে যারা সরকারে এসেছে তারা আমাদেরকে দেশে ফিরতে দেবে না। এরপর ক্ষমতায় আসলো জিয়াউর রহমান। তিনিও খবর পাঠালেন, যেন আমরা কেউ দেশে ফিরতে না পারি। পরে আমরা সেখানেই আশ্রয় নিয়ে থেকে গেলাম।’

বলতে বলতে আবার নিঃশব্দে কাঁদের শেখ হাসিনা। এ সময় পুরো মিলনায়তনে ছিল পিনপতন নীরবতা। হাত দিয়ে চোখের জল মুছতে দেখা গেছে অনেককেই।

৭৫ থেকে ৮১ পর্যন্ত স্মৃতি

এই ছয়টি বছর বলতে গেলে ভারতেই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। মাঝে ছোট বোন শেখ রেহানার বিয়ে হয়। আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান এই বিয়ে আগেই ঠিক করে রেখেছিলে। লন্ডন থেকে শেখ রেহানার শ্বশুর-শাশুড়ি এসে নিয়ে যান রেহানাকে।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি পরিবারের একমাত্র বেঁচে যাওয়া সদস্য। অথচ আমিই তার বিয়েতে যেতে পারিনি। কারণ, আমার কাছে বিমান ভাড়া ছিল না। পরে ১৯৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধি আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি লন্ডনে যাওয়ার টিকিট আর আবাসনের ব্যবস্থা করে দেন। এরপর সন্তানসম্ভবা বোনকে দেখতে লন্ডন যান শেখ হাসিনা।

এর আগে ১৯৭৯ সালে শেখ রেহানা সুইডেনে গিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে একটি সমাবেশ করেছিলেন।

শেখ হাসিনা জানান, তখন লন্ডনেও পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। আমরা সভা করতে গেলেই ছুরি নিয়ে মারতে আসতো। এর মধ্যেই জনসভা করি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাই।

বিখ্যাত রাজনীতিক স্যার টমাস উইলিয়ামস তখন সব জানতে পেরে বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত করতে বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান তাকে বাংলাদেশে আসতে দেননি।

দেশ ফেরার পর আরেক ধরনের নিষ্ঠুরতা

১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দায়িত্বে থাকবো এ চিন্তা কখনও করিনি। কিন্তু দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতে হবে-এটা জানতাম। ১৯৮১ সালে আমাকে যখন সভাপতি নির্বাচিত করা হয় তখন দিল্লি থেকে ফিরে আসি। ১৭ মে যখন দেশে ফিরে আসলাম তখন লাখো মানুষের ঢল।’

ফেরার পর নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি শেখ হাসিনা। বলেন, ‘যখন এই দেশ ছেড়ে যাই তখন তেজগাঁও বিমানবন্দরে কামাল, জামাল, তাদের স্ত্রী সবাই ছিল। ফিরে এসে কাউকে পাইনি।’

শেখ হাসিনা জানান, দেশে ফেরার পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি তাকে যেতে দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘সেখানে যেতে চেয়েছিলাম একটু মিলাদ পড়বো। কিন্তু ওই বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। বাইরেই রাস্তায় বসে মিলাদ পড়ে চলে আসি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘যতদিন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় ছিল, আমাকে ওই বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয়নি। বিনিময়ে অনেক বাড়ি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু খুনির কাছ থেকে কিছু নেয়া আমার রুচিতে হয়নি।’

নয়াদিল্লি এবং লন্ডনে থাকার সময় জিয়াউর রহমান তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি বলেছি খুনির চেহারা দেখতে চাই না।’

বাড়ি হস্তান্তর নিয়েও চক্রান্ত

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তড়িঘড়ি করে ৩২ নম্বরের বাড়িটি হস্তান্তর করা হয় বলে জানান শেখ হাসিনা। বলেন ওটাও ছিল এক চক্রান্ত। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি ওই বাড়িতে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারিনি। অর্ধেকটা উঠার পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তখন ছাদে নেয়া হয়। বলা হয় অনেকগুলো কাগজে সই করতে। আমি অর্ধেক অচেতন অবস্থায় সই করলাম।’

শেখ হাসিনা বলেন, বলা হয়, আমি সই করে ওই বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ বুঝে নিয়েছি। তিনি বলেন, ‘জিয়া হত্যার পর টেলিভিশনে ৪০ দিন ধরে প্রচার চলছিল সে নাকি স্যান্ডো গেঞ্জি আর ভাঙা সুটকেস রেখে গেছে। জিয়ার জন্য মায়াকান্না আর বঙ্গবন্ধুর নামে অপপ্রচার। আমি নাকি সই করে নিয়েছি বিপুল পরিমাণ সম্পদ সই করে নিয়েছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কত বড় নিষ্ঠুরতা, আপনারা একবার চিন্তা করে দেখুন। ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ১০০টাকার নোট বাতিল ঘোষণা করেছিলেন। সেই টাকা ট্রাংকে করে বাড়িতে আনা হয়েছিল। বলা হয়েছে সাত লক্ষ টাকার সোনাদানা রাখা হয়েছে। একদিকে শোক, অন্যদিকে এই অপপ্রচার। কত মানসিক যন্ত্রণা ছিল।’

কষ্ট দিতেই ১৫ আগস্ট খালেদার জন্মদিন উদযাপন

১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনের নিন্দা করেন শেখ হাসিনা। বলেন, ‘এটা তার জন্মদিন নয়, কেবল আমাদেরকে আঘাত দেয়ার জন্য কেক কেটে সেজেগুজে জন্মদিন পালন করেন। কাল শুনলাম করবেন না, কেউ কেউ রাজনৈতিকভাবে তার নাকি উদারতা। কিন্তু আমি তো জানি তিনি কেন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১২ আগস্ট তার ছেলে কোকোর জন্মদিন। মা তো, কিছুটা হলেও মায়া আছে। ছেলের জন্মদিন পালন করতে পারবেন না বলে নিজের মিথ্যা জন্মদিন তিনি পালন করেননি।’



মন্তব্য চালু নেই