একজন আপাদমস্তক শিল্পী, স্বপ্নের কারিগর

সারা জীবন যিনি সাধারণ মানুষকে ধারণ করেছেন রঙ তুলিতে। জীবনঘনিষ্ট চিত্র যার তুলিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে অসংখ্যবার, তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। তিনি ছিলেন স্বপ্নের কারিগর। তার রঙ আর ক্যানভাস ছিল সাম্য, সত্য আর শুদ্ধেরই প্রতিফলন।

মহান এ মানুষটির ১০১ তম জন্মদিন আজ। ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলার কেন্দুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পুলিশের দারোগা। মা জয়নাবুন্নেছা গৃহিনী। নয় ভাইবোনের মধ্যে জয়নুল আবেদীন ছিলেন সবার বড়।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে নিয়েছিলেন তার শিল্পের প্রধান উপকরণ হিসেবে। মানুষের দুর্দশা, কষ্টকে সামনে এনে চিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছেন বাস্তবতাকে।

অসাধারণ এ মানুষটির পড়াশোনার হাতেখড়ি পরিবারের কাছ থেকেই। খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি ছবি আঁকা পছন্দ করতেন। পাখির বাসা, পাখি, মাছ, গরু-ছাগলের ছবি এঁকে মা-বাবাকে দেখাতেন। ছেলেবেলা থেকেই শিল্পকলার প্রতি ছিল তার গভীর আগ্রহ। ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই স্কুলের পড়ালেখার বাদ দিয়ে কলকাতায় চলে যান তিনি।মায়ের অনুপ্রেরণায় সেখানে গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসে ভর্তি হন জয়নুল আবেদীন।

তার আগ্রহ দেখে মা নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতার আর্ট স্কুলে ভর্তি করান। জয়নুল আবেদীন ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে পড়েন। ১৯৩৮ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন।

জয়নুল আবেদীনের মধ্যে ছোটবেলা থেকে গড়ে ওঠে জীবন ও প্রকৃতিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার প্রবণতা। তার লেখা ‘আমি যখন ছোট ছিলাম’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ছাত্রাবস্থায় তার আঁকা শম্ভুগঞ্জ (কালি ও কলম, ১৯৩৩), বাঁশের সাঁকো ( জলরং, ১৯৩৩), পল্লীদৃশ্য ( ১৯৩৪), ফসল মাড়াই (তেলরং, ১৯৩৮), মজুর (১৯৩৫) চিত্রকর্মে এসব পর্যবেক্ষণের প্রকাশ ঘটে। ওই সময়ে জয়নুলের ছবিতে ফুটে ওঠে গ্রামবাংলার দৃশ্য ও জীবন, যার আড়ালে ছিল প্রত্যক্ষ জগতের অনুভব, স্বভাবনিষ্ঠতা ও গভীর ঐতিহ্যবোধ।

তেতাল্লিশে কলকাতা মহানগরে ঘটেছে মানবতার চরম অবমাননা। ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট থেকে খাদ্যান্বেষণে তীব্র প্রতিযোগিতা চলেছে মানুষ আর কুকুরের মধ্যে। জয়নুল এ রকম অমানবিক দৃশ্যে প্রচণ্ডভাবে মর্মাহত হন, আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সেই আবেগকে কাজে লাগিয়ে তিনি দিন রাত শুধু কলকাতার দুর্ভিক্ষের নারকীয় দৃশ্যাবলির স্কেচ করতে থাকেন। সেই দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা ও বাস্তবতা আজও প্রত্যক্ষ করা যায় তার সেই ছবির মাধ্যমে। তার আঁকা প্রতিটি ছবিই একেকটি সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে এবং বাস্তব অবস্থাকে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে।

এক অসাধারণ শক্তিশালী অঙ্কন শৈলীর মাধ্যমে তিনি দুর্ভিক্ষের করুণ বাস্তব দৃশ্যাবলি চিত্রায়িত করতেন, যার কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত উপমহাদেশের চিত্র ঐতিহ্যে ছিল না। জয়নুলের দুর্ভিক্ষের স্কেচগুলো দেখার পর ‘ভারতের নাইটিঙ্গেল’ শ্রীমতি সরোজিনি নাইডু মন্তব্য করেছিলেন, ‘সব চাইতে মর্মস্পর্শী ও আবেগময় বর্ণনার চাইতেও তার এসব ছবির আবেদন অধিকতর।’

চুয়ান্নর পরবর্তী সময় জয়নুল আবেদিন সময় ব্যয় করেন আর্ট ইন্সটিটিউটের মান উন্নয়ন, ছাত্র ও শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি যুগোপযোগী করে তোলা, গ্রন্থাগার তৈরি, আর্ট ইন্সটিটিউটের জন্য মনোজ্ঞ ভবন নির্মাণের কাজে। এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে শিল্পের প্রতি অনুরক্ত করতে চেষ্টা করেন তিনি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি নিজে শিল্পকর্ম করে যতটা আনন্দ পাই তার চেয়ে বেশি আনন্দ পাই শিল্পকে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে দেখলে।’

১৯৬৯ সালে জয়নুল আবেদিন ৬৫ ফুট দৈর্ঘ্যের বিশাল ম্যুরাল সদৃশ চিত্রকর্ম নবান্ন আঁকেন। যখন এই ছবিটি আঁকেন তখন বাঙ্গালি স্বাধিকার আদায়ের জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ বিভেদ ঘুচিয়ে বিশাল গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটই তার চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু পরিবর্তন করে দেয়। ‘নবান্ন’ চিত্রটিতে তিনি তুলে ধরেন কৃষকের দুঃখ কষ্ট স্বপ্নের সামগ্রিক রূপ। ঐশ্বর্যশালী সুখী জীবন কীভাবে ঔপনিবেশিক শোষণে নিষ্পেষিত হয়ে দৈন্যের চরম সীমায় পৌঁছে তার ইতিহাসও ফুটে ওঠে এই চিত্রে।

১৯৭০ সালে ৩০ ফুট দীর্ঘ মনপুরা-৭০ চিত্রকর্মটি তৈরি করেন জয়নুল আবেদিন। ১৯৭০ সালে ফিলিস্তিনের যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করে ও ১৯৭১ সালে এদেশে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা হলে জয়নুল সেসব নিয়েও বিভিন্ন চিত্রকর্ম তৈরি করেন।

ছয় মাস ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে ৬২ বছর বয়সে মহান এ শিল্পী মৃত্যুবরণ করেন। তার অসাধারণ শিল্প-প্রতিভা এবং তার মহৎ মানবিক গুণাবলির জন্যে তিনি দেশে ও বিদেশে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, সরকার এবং জনগণের কাছ থেকে পেয়েছেন সম্মান।

জয়নাল আবেদীন নিজে যেমন একজন আপাদমস্তক শিল্পী ছিলেন, তেমনি শিল্পী সৃষ্টির লক্ষ্যেও কাজ করে গেছেন সারা জীবন। এ লক্ষ্যে পরম ভালবাসায় নিজের হাতেই ১৯৪৮ সালে ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। যা আজ ঢাকা বিশ্ববিধ্যালয়ের অধীনে চারুকলা ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত। দেশে চারুকলার উন্নয়নে জয়নুল আবেদিন তার অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি পেয়েছেন ‘শিল্পাচার্য’সম্বোধনে।

তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য জাতীয় জাদুঘরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জয়নুল আবেদীন গ্যালারি। প্রায় ৭০০ ছবি এই সংগ্রহশালায় রয়েছে। শিল্পাচার্যের জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।



মন্তব্য চালু নেই