উন্নয়ন প্রকল্প সংশোধনের নামে হরিলুট : ১৫ প্রকল্পেই গচ্চা ২ হাজার কোটি টাকা!

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ১২২ কোটি ২২ লাখ টাকা। ২০০৭ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু নানা অজুহাতে দফায় দফায় মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়। শেষ পর্যন্ত চার বছরের প্রকল্প শেষ হয়েছে দশ বছরে। আর এতে ব্যয় বেড়েছে ৮৮ দশমিক ৯২ শতাংশ।খবর যুগান্তরের।

অতিরিক্ত ব্যয় হয় ১০৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। তিনবার প্রকল্প সংশোধন ও মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০১৩ সালের জুন মাসে প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। এতে ১৫০ শতাংশেরও বেশি সময় ব্যয় হয়েছে। অথচ প্রকল্পটি সময়মতো বাস্তবায়ন হলে ব্যয় অনেক কম হতো।

কনস্ট্রাকশন অব চাঁদপুর ১৫০ মেগাওয়াট সাইকেল পাওয়ার স্টেশন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেড ইভাকুয়েশন ফ্যাসিলিটিজ প্রকল্পে অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২৮২ কোটি টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যয় দেখানো হয়েছে ১১৯২ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে ৯১০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে অনুমোদিত ব্যয়ের তুলনায় বেশি ব্যয় হয়েছে ৩২০ শতাংশের ওপরে।

শুধু এ দুটি প্রকল্পই নয়, নানা অজুহাতে বাস্তবায়ন সময় ও ব্যয় বাড়ানোয় গুরুত্বপূর্ণ ১৫টি প্রকল্পে গচ্চা গেছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। খোদ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র। কিন্তু কেন এভাবে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে তা নিয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। দায়িত্বে অবহেলার জন্যও কাউকে দায়ী করা হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প সংশোধনের নামে ইচ্ছামতো ব্যয় বাড়িয়ে সরকারি অর্থের হরিলুট চলছে। প্রকল্প তৈরি ও অনুমোদনের সময়ই প্রকল্পটি কবে কোথায় কিভাবে বাস্তবায়ন হবে, অর্থ কোথা থেকে আসবে তা যাচাই-বাছাই করেই চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সর্বোচ্চ ফোরামের বৈঠকে তা অনুমোদন করা হয়। কিন্তু এরপরই শুরু হয় নানা ধরনের অসাধু কর্মকাণ্ড। বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারের যোগসাজশে নানা অজুহাত তৈরি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করা হয়। প্রকল্পের এক পর্যায়ে এসে নানা অজুহাত দেখিয়ে বাস্তবায়ন বিলম্বিত করা হয়। আর এই বিলম্বের অজুহাতে প্রকল্প ব্যয়ও বাড়ানো হয়। এভাবে প্রকল্পের অর্থ নিয়ে অনিয়ম চলছে বলে সূত্র দাবি করেছে।

প্রশ্ন উঠেছে খোদ রাজধানীতেই যদি ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের এমন করুণ হাল হয়, তাহলে ঢাকার বাইরের অন্য প্রকল্পগুলোর কি অবস্থা? পরিকল্পনা কমিশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র বলছেন, এটি একটি পুরনো কৌশল। এতে আর্থিক অনিয়ম অনেক বেড়ে যায়। সরকারের অর্থের অপচয় ঘটে। এজন্য বারবার প্রকল্প সংশোধনের নামে ব্যয় বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা গচ্চা দেয়ার রীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় যে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হচ্ছে এটা অবশ্যই এক ধরনের সরকারি অর্থের অপচয় এবং অপব্যবহার।

জানা গেছে, প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়নে ক্রটি, নানা ধরনের অনিয়ম, রেট সিডিউল পরিবর্তন, মাঝপথে নতুন অঙ্গ সংযোজনের নামে কালক্ষেপণ, দূরদর্শিতার অভাব, মনিটরিং না থাকা বা দুর্বল তদারকি, ঘনঘন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) পরিবর্তন, সংশ্লিষ্টদের দক্ষতার অভাব, অর্থছাড়ে বিলম্ব, জটিল ও ব্যতিক্রমী কাজের ক্ষেত্রে অনেক সময় টার্ন কি ঠিকাদারের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা এবং প্রকল্প ঝুলিয়ে রেখে বেতন ও অন্যান্য সুবিধা ভোগের প্রবণতা ইত্যাদি কারণেই প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ও ব্যয় বাড়ছে। প্রতি বছর সরকারকে এ জন্য গচ্চা দিতে হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।

পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল এর আগে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা রয়েছে যে, এখন থেকে বারবার প্রকল্প সংশোধন করা হবে না। যদি একান্তই প্রয়োজন হয় তাহলে সেটি সমাপ্ত ঘোষণা করে নতুন প্রকল্প নিতে হবে। তাছাড়া দেখা যায়, প্রকল্পের মাঝপথে নতুন অঙ্গ সংযোজন করে অতিরিক্ত ব্যয় বাড়ানো হয়। সেটি আর থাকবে না। অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ীই প্রকল্প সমাপ্ত করতে হবে। এ বিষয়ে আমরা কঠোর নজরদারি করব।

আইএমইডি বলছে, ভবিষ্যতে প্রকল্প প্রণয়নের সময় বাস্তবসম্মতভাবে ব্যয় ও সময় নির্ধারণে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। ঘনঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি বা পরিবর্তন না করার বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে হবে এবং প্রকিউরমেন্ট (কেনাকাটা) সংক্রান্ত সব কাজ যাতে চুক্তি মূল্যের মধ্যে সমাপ্ত হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

আইএমইডির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোতে অতিরিক্ত ব্যয় বৃদ্ধি ও অত্যধিক বিলম্বের ঘটনা বেশি ঘটেছে। এক্ষেত্রে কনস্ট্রাকশন অব চাঁদপুর ১৫০ মেগাওয়াট সাইকেল পাওয়ার স্টেশন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেড ইভাকুয়েশন ফ্যাসিলিটিজ প্রকল্পটিতে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে ৯১০ কোটি ১ লাখ টাকা। এ জন্য প্রকল্প সংশোধন করতে হয়েছে দু’বার।

প্রকল্পটি ২০০১ থেকে শুরু হয়ে ২০০৪ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু সমাপ্ত হয়েছে ২০১৩ সালের জুন মাসে। এতে অতিরিক্ত সময় লেগেছে ৯ বছর, যা মূল অনুমোদিত ডিপিপির তুলনায় ৩০০ শতাংশ বেশি। একই অবস্থা সিদ্ধিরগঞ্জ ২৪০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণ প্রকল্পেও। মূল ব্যয় ছিল ৬৬৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা। কিন্তু প্রকৃত ব্যয় হয় ১ হাজার ১৫৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এতে অতিরিক্ত ব্যয় হয় প্রায় ৪৭২ কোটি টাকা, যা মূল অনুমোদিত ব্যয়ের ১৬৮ শতাংশ বেশি। দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও দু’বার প্রকল্প সংশোধন ও দু’বার মেয়াদ বৃদ্ধির অতিরিক্ত সময় লেগেছে প্রায় ৭ বছর। এক্ষেত্রে পরামর্শক নিয়োগে বিলম্ব, দরপত্র প্রক্রিয়াকরণ ও মূল্যায়নে দেরি, দরপত্রের প্রাপ্ত দর ডিপিপি ব্যয় অপেক্ষা বেশি, প্রকল্পের কার্যপরিধি এবং ডলারের বিনিময় হারের পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণকে দায়ী করা হয়েছে।

এছাড়া ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১ ও ২ নম্বর ইউনিট পুনর্বাসন ও আধুনিকায়ন প্রকল্পের মূল ব্যয় ছিল ১১৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ১২৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা, যা মূল অনুমোদিত ব্যয়ের তুলনায় ৪০ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। বাস্তবায়নের সময় ছিল ১৯৯৭ সালের জুলাই থেকে ১৯৯৯ সালের জুন পর্যন্ত।

কিন্তু প্রকল্পটি সমাপ্ত হয়েছে ২০১৩ সালের জুন মাসে। অতিরিক্ত সময় লেগেছে ১৪ বছর, যা অনুমোদিত বাস্তবায়নকালের তুলনায় ৬০০ শতাংশ বেশি। একই অবস্থা হয়েছে সেন্টাল ব্যাংক স্ট্রেনদেনিং প্রকল্পেও। প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ২৮৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। পরবর্তীকালে চতুর্থ সংশোধনীতে ৫৫২ কোটি বাড়িয়ে মোট ব্যয় ধরা হয় ৪১০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। শেষ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩৩৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে ৫২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, যা মূল ব্যয়ের চেয়ে ১৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অতিরিক্ত সময় লেগেছে প্রায় ৬ বছর।

আইএমইডি সূত্র জানায়, অতিরিক্ত ব্যয় হওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, সালটিয়া বাজার-হাজীগঞ্জ বাজার-দেওয়ানগঞ্জ বাজার সড়কে পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সেতু নির্মাণ প্রকল্প। বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের অবকাঠামো ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও পরিবেশ উন্নয়ন।

পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প : পার্বত্য চট্টগ্রাম (১ম সংশোধিত)। কিশোরগঞ্জ-নিকলী (মোহরকোনা সংযোগসহ) সড়ক উন্নয়ন, সিলেট-জকিগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প। মানিকগঞ্জ সড়ক বিভাগাধীন গোলড়া-সাটুরিয়া সড়কের বিভিন্ন কিলোমিটারে ৬টি সেতু নির্মাণ। এতিম ও প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের জন্য ৬টি বিভাগে ৬টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ স্থাপন এবং স্ট্রেনদেনিং ডেসকোস ইলেকট্রিক ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক (১ম সংশোধিত) প্রকল্প।



মন্তব্য চালু নেই