উত্তরাঞ্চলে বন্যায় দুর্ভোগ চরমে

উত্তরের জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ওই অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলছে। চোখের সামনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ভিটেমাটি। হাজার হাজার হেক্টর জমির আমন ধান ও শাক-সবজির আবাদ নষ্ট হয়ে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে শিক্ষা কার্যক্রম। প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। ফলে বন্যা কবলিত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। পনিবন্দি মানুষেরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ত্রাণ সহায়তা আর পুনর্বাসনের অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে কয়েকটি জেলার কয়েক লাখ মানুষ।

সিরাজগঞ্জ: যমুনার পানি কিছুটা কমলেও বন্যার সার্বিক অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। রবিবার দুপুরে সিরাজগঞ্জ পয়েন্ট যমুনার পানি ৫ সেন্টিমিটার কমে তা বিপদসীমার ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, যমুনা নদীর পানি কিছুটা কমলেও জোয়ার বেশি থাকায় পানি বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এদিকে নদীতে পানি না বাড়লে সিরাজগঞ্জের অভ্যন্তরীণ নদ নদীর পানি ভরে গেছে। বন্যায় সিরাজগঞ্জ জেলা সদরের ৮২টি ইউনিয়নের প্রায় ৬০টি ইউনিয়নে পানি প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে খোকশাবাড়ি, রতনকান্দি, ছোনগাছা, মেছড়া, কাওয়াখোলা, কালিয়া হরিপুর ও সয়দাবাদ ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রাম, কাজিপুর উপজেলার মাইজবাড়ী, কাজিপুর সদর, শুভগাছা, গান্ধাইলের আংশিক, তেকানী, নিশ্চিন্তপুর, চরগিরিশ, নাটুয়ারপাড়া, খাসরাজবাড়ী ও মনসুর নগর ইউপির প্রায় ৯০টি গ্রাম, শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরি, জালালপুর, গালা, সোনাতনি ইউনিয়নের ৩০টি গ্রাম, চৌহালী উপজেলার সোদিয়া চাদপুর, স্থল, খাস কাউলিয়া ও খাস পুকুরিয়া ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রাম, যমুনা ও করতোয়া নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় উল্লাপাড়ার উধুনিয়া, বড় পাঙ্গাসী, লাহিড়ী মোহনপুরের কালিয়াকৈড়, সুজা, বংকিরাট, বাঙ্গালা, সলপ ও পঞ্চক্রোশী ইউনিয়নের প্রায় ৬০টি গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। তাড়াশ উপজেলার চলনবিল অধ্যুষিত প্রায় সকল ইউনিয়নের ৫০টি গ্রামসহ ৯টি উপজেলার প্রায় ৫০টি ইউনিয়নের চার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এ কারণে জেলার তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। এ সকল এলাকার শতাধিক হেক্টর জমির ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
এ সকল এলাকার স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, ঘরবাড়িসহ টিউবয়েল ডুবে গেছে। দেখা দিয়েছে খাবার পানির সংকট। ফলে পেটের পীড়া, ডাইরিয়াসহ নানা অসুখ বেড়েছে বলে চরাঞ্চলের মানুষ জানিয়েছে। বন্যা কবলিত মানুষ তাদের সাধারণ কাজকর্ম না করতে না পারায় কষ্টে জীবনযাপন করছে। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র বাঁধের ওপর আশ্রয় নেয়া মানুষ এখন বেশি কষ্টে রয়েছে। সরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোনো ত্রাণ না পৌঁছায় সেসব অঞ্চলের মানুষ কষ্টে দিনাতিপাত করছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) বিল্লাল হোসেন জানান, বন্যার পানি কিছুটা কমলেও জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করা হচ্ছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যায়ক্রমে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। অন্যান্য উপজেলার তালিকা পাওয়া গেলে তাদেরও ত্রাণ দেয়া হবে।

সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা): তিস্তায় পানি আকস্মিক ভাবে বেড়ে যাওয়ায় সুন্দরগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতিকে বিজ্ঞমহল ১৯৮৮ সালের বন্যার সাথে তুলনা করেছেন। থৈ থৈ পানিতে ভাসছে ৭টি ইউনিয়নের প্রায় ৪০টি গ্রাম। ডুবে গেছে সদ্য রোপন করা প্রায় হাজার একর আমন ক্ষেত। পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় তীব্র ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারিভাবে যে পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবেই অপ্রতুল।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বর্তমানে বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে তিস্তার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে দহবন্দ এবং শান্তিরাম ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, চন্ডিপুর, কঞ্চিবাড়ি, শ্রীপুর ও কাপাশিয়া ইউনিয়নের প্রায় ৪০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
সরকারি-বেসরকারি ভাবে এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের ত্রাণ তহবিল হতে ৪১ মেট্রিক টন চাল, ৪০ হাজার টাকার শুকনো ত্রাণ সামগ্রী এবং সমাজ সেবা অধিদপ্তরের ৬’শ প্যাকেট ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।

লালমনিরহাট: রোববার বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে এই জেলায়। দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা সেচ প্রকল্প ব্যারাজের ভাটিতে শহর রক্ষা বাঁধের কয়েক জায়গায় ভেঙ্গে যাওয়ায় নতুন নতুন এলাকায় বন্যার পানি প্লাবিত হচ্ছে। গত ৭ দিন ধরে জেলার ৫ উপজেলার ৮০ গ্রামের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। পানির গতি নিয়ন্ত্রণ করতে তিস্তা ব্যারাজের সব গেট খুলে দেওয়া হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড দোয়ানী ডালিয়া শাখার প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সহকারী প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান জানান, ভারতে বন্যা দেখা দেওয়ায় প্রচণ্ড গতিতে পানি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। তার মতে, ভারতে গজল ডোবা ব্যারাজের সকল গেট খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশে প্রতি মূহুর্তে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। পানি তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় বিপদ সীমার ৪৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানির গতি বেড়ে গেলে তিস্তা ব্যারাজ রক্ষার্থে ফ্লাড বাইপাস যে কোন মূহুর্তে কেটে দেওয়া হবে। ওই ফ্লাডবাইপাস কেটে দেওয়া হলে গোটা জেলার কয়েক লক্ষ মানুষ পানি বন্দি হয়ে পরবে।
এদিকে বন্যাকবলিত এলকার পানি বন্দি লোকজনের বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়ে মানবতার সাথে জীবনযাপন করছে।
রোববার সকালে বন্যা কবলিত এলাকা গুলো সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ওইসব এলাকার মানুষ পানি রয়েছে কয়েক দিন ধরে। লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমির ফসল পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেঠে। পানিবন্দি লোকজন গরু, ছাগলসহ বিভিন্ন গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পরেছে। প্রসাশনের পক্ষ থেকে যে ত্রাণ বরাদ্দ করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে বন্যা পরিস্থিতির খোঁজ খবর নেওয়ার পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। ত্রাণের জন্য উচ্চ পর্যায়ে আরও আবেদন করা হয়েছে।

কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি হ্রাস পেলেও তিস্তার পানি ১৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরিবর্তিত রয়েছে ধরলার পানি। বসত ভিটা তলিয়ে থাকায় দুর্ভোগ কমেনি বানভাসীদের। অন্যদিকে পানি কমতে শুরু করায় দেখা দিয়েছে নদ-নদীর ভাঙ্গন। ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে ঘর-বাড়ী ও বিস্তির্ণ এলাকা।
গত ২৪ ঘন্টায় চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ৫ সেন্টিমিটার, নুন খাওয়া পয়েন্টে ৩ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তার নদীর পানি ১৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেলেও ধরলার পানি অপরিবর্তিত রয়েছে।
জেলার ৯ উপজেলার ৪০ ইউনিয়নের নদ-নদী তীরবর্তী ২ শতাধিক চর ও দ্বীপচরসহ নিন্মাঞ্চলের প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ গত ৮ দিন ধরে পানি বন্দী জীবন-যাপন করছে। তাদের সঞ্চিত খাবার ফুরিয়ে যাওয়ায় চরম খাদ্য সংকটে পড়েছে। ত্রাণ না পেয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে অনেক পরিবারের। বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
জেলা প্রশাসক এবিএম আজাদ জানান, বন্যার্তদের জন্য ২শ’ ৫০ মেট্রিক টন চাল ও ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই