বনবিভাগের দায়সারা প্রচারণা

উখিয়ায় বনভূমির পাহাড়ে ২০ হাজার মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস

অবিরাম বর্ষন চলছেই, কিন্তু পাহাড় গুলোতে ঝুকিপূর্ণ মানুষের সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েই চলছে। উখিয়ার বিভিন্ন বনভূমির পাহাড়ের উপরে, ঢালুতে ও নিচে অনিশ্চিত জীবন নিয়ে বসবাস করছে প্রায় ২০ হাজার হতদরিদ্র পরিবার। বিগত সময়ে পাহাড় ধ্বসে প্রায় ১৫ নারী, পুরুষ, শিশু প্রাণ হারালেও টনক নড়েনি উপজেলা বনকর্তা ব্যক্তিদের। পাহাড়ে বসবাসরত পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে পুর্নবাসনের উদ্যোগ গ্রহণ না করায় প্রতি বর্ষা মৌসুমে অকাল মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বর্ষার শুরুতে বন বিভাগ শুধুমাত্র পাহাড়ে বসবাসরত পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করে দায়সারা প্রচারণার মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব শেষ করতে দেখা গেছে।

সরকারের সমন্বিত দুযোর্গ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচী (সিডিএমপি) কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ এলাকা পাহাড় গুলোর ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারন করেছে। তাতে দেখা গেছে এ দুই এলাকার পাহাড়গুলোর ৭৫ শতাংশই বালু মিশ্রিত। সেখানে বসতি তো দূরের কথা, কোন ধরনের অবকাঠামো নির্মানের জন্য উপযুক্ত নয়। কিন্তু এসব পাহাড়ের জমিজমাগুলো সরকারি বন বিভাগের হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসা উপজাতি, স্থানীয় হতদরিদ্র পরিবার ও প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে প্রায় ২০ হাজার মানুষ পাহাড়ের উপরে, ঢালুতে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।

পাহাড় কেটে শ্রেণী পরিবর্তন করায় এসব স্থানগুলো আরো ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ ও সংশোধিত ২০১০ এর ৪ ধারায় বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারী বা আধা সরকারী বা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলীয় অথবা ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাবে না। এ আইনে পাহাড় কাটার অপরাধে সর্বোচ্চ দুই বছরের জেল ও ৫ লাখ টাকার জরিমানা বিধান থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন বিভাগ পাহাড় কাটার অপরাধে এ পর্যন্তও কাউকে জরিমানা বা শাস্তির আওতায় আনেনি। যে কারনে উখিয়ায় পাহাড় দখল, কর্তন, স্থাপনা তৈরি ও অবৈধ বসবাস অব্যাহত রয়েছে।

১৯৮৭ সালে তৎকালীন সরকার লট নিলাম প্রথা বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে উখিয়া সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনাঞ্চলে বনসম্পদ লুটপাট, বনভূমির অবৈধ দখল প্রবণতা শুরু হয়। এক শ্রেণীর ভূমিদস্যু বনভূমি দখল করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে হাত বদল করার ধারাবাহিকতায় এখানকার বনাঞ্চলের পাহাড় টিলায় অবৈধ বসতি স্থাপন বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি ২০০৫ সালে বৃহত্তর ইনানী উপকূলীয় এলাকায় এক্সক্লুসিভ ট্যুরিষ্ট জোন হিসেবে গড়ে তোলার সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করলে রাতারাতি এখানকার জমি জমার দাম আশংকাজনকভাবে বেড়ে যায়।

এমতাবস্থায় উপকূলে বসবাসরত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের বসত ভিটা সর্বস্ব পরিবারগুলো তাদের সহায় সম্বল মোটা অংকের টাকায় বিক্রি করে ইনানীর সরকারী বনাঞ্চলের পাহাড়ে অবৈধ বসতি গড়ে তোলে। গত ৭ বছরে ইনানীর পাহাড় দখল করে প্রায় ১০ হাজারেরও অধিক অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে বলে দাবী করেন মনখালী বন রক্ষা সহায়ক কমিটির সভাপতি নুরুল আবছার। তিনি আরো জানান, ইনানী বনরেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিট কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগীতায় প্রতিনিয়ত ইনানীর বিভিন্ন পাহাড় দখল করে মাটি কেটে শ্রেণী পরিবর্তন করে অবৈধ স্থাপনা তৈরী করা হচ্ছে।

উখিয়া ও ইনানী বন রেঞ্জের আওতায় মনখালী, ছেপটখালী, জুম্মা পাড়া, মোঃ শফির বিল, ইনানী জুমের ছড়া, সোনাই ছড়ি, পাইন্যাশিয়া, তুতুরবিল, হরিণমারা, তেলখোলা, মোছারখোলা, হাতির ঘোনা, মধুর ছড়া, মাছকারিয়া, দোছড়ি, থিমছড়ি, তুলাতলী, সোনার ঘোনা, ডেইল পাড়া, ভালুকিয়া, তুলাতলী, চিকনঝিরি ও পাগলির বিল সহ প্রায় ২৮টি ছোট ছোট পাহাড় দখল করে মাটি কেটে শ্রেণী পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় পাহাড়ের উপরে, ঢালুতে ও নিচে অবৈধভাবে বসবাস করছে প্রায় ২০ হাজার পরিবার। ২০১০ সনের ১৫ জুন প্রবল বর্ষন পরবর্তী সৃষ্ট বন্যায় পালংখালী ইউনিয়নে থাইংখালী গ্রামে একই পরিবারের ৩ জন, রাজাপালং ইউনিয়নের সাদৃকাটা গ্রামে ১ জন ও ছেপটখালী গ্রামে ১ জন সহ ৫ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু পাহাড় ধ্বসে ঘর ছাপা পড়ে আহত হয়েছিল। ২০১১ সালে জুন মাসে জালিয়া পালং ইউনিয়নের সোনাইছড়ি গ্রামে পাহাড় ধ্বসের ঘটনায় এলাকার জনমনে আতংকের সৃষ্টি হলেও দারিদ্রতার অশ্বপৃষ্টে বাধা এসব পরিবারগুলো স্থান পরিবর্তন করতে পারেনি।

এমতাবস্থায়, ভালুকিয়ার থিমছড়ি এলাকায় একই পরিবারের ৩ জন সহ ৭ জন নিহত হয়েছে। এ সময় শত শত ঘরবাড়ি পাহাড়ের নিচে চাপা পড়লেও দারিদ্রতার অভাবে এসব মানুষগুলো এখনও অজানা আতংক নিয়ে একই এলাকায় বসবাস করছে।

হলদিয়াপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মিন্টু জানান, এসব পরিবারগুলো নিঃশ্ব, তাদের নিজস্ব কোন পৈত্রিক সহায় সম্পত্তি না থাকার কারণে বন বিভাগের জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। রতœাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল কবির চৌধুরী জানান, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় মানুষ তাদের পরিবাব পরিজন নিয়ে আশ্রয়ের আশা করে ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে।

এভাবে পরবর্তীতে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে মৃত্যুর মিছিলে আরো অসংখ্য মানুষ যোগ হতে পারে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করে এসব ছিন্নমুল পরিবারগুলোর স্থায়ী পুনর্বাসনের দাবী জানান। উখিয়া ও ইনানীর রেঞ্জ কর্মকর্তা মির আহমদ জানান, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসরত পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই