ইয়াবা পাচারে রোহিঙ্গারা

জীবনের ঝুঁকি থাকলেও কম সময়ে বেশি আয়ের সুযোগ থাকায় অনেকটা ‘সহায়-সম্বলহীন’ রোহিঙ্গারা ইয়াবা পাচারের সঙ্গে বেশি জড়িয়ে পড়ছেন বলে ক্সবাজারের স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। পাশ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্যই মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলেও জানান তারা।
টেকনাফের রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক বলেন, “রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের চেয়ে পরিশ্রমী হয়। এরা কম দামের শ্রমিক হয়ে সাগরে মাছ ধরতে যায়। এসব শ্রমের পাশাপাশি ইয়াবা ব্যবসায়ীরা রোহিঙ্গাদের দিয়ে ইয়াবা বহন করায়।”
তার এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় কক্সবাজার জেলা কারাগারে বন্দি ইয়াবা পাচারে জড়িতদের পরিসংখ্যানে।
কারাগারের তথ্য অনুযায়ী, ইয়াবা পাচারে জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার ৯০ জন বর্তমানে কক্সবাজার কারাগারে আছেন, যাদের ৮২ জনই রোহিঙ্গা।
তবে ইয়াবা পাচারে জড়িতরা ধরা পড়লেও এর ব্যবসায়ীরা দৃশ্যত ধরা-ছোয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহাম্মেদ বলেন, “আমরা যাদের ধরছি তাদের অধিকাংশই কেরিয়ার (বহনকারী)। আর এদের মধ্যে বেশিরভাগই রোহিঙ্গা।”
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশে ইয়াবা মূলত প্রবেশ করে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী কক্সবাজার জেলার অন্তত ৪৫টি রুট দিয়ে।
সীমান্ত থেকে এসব রুটের যে কোনোটি দিয়ে কক্সবাজার ও তার আশপাশের এলাকায় দুই হাজার ইয়াবা বড়ি এনে দিতে পারলে একজন পাচারকারী এক থেকে দেড় হাজার টাকা পান।
নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়ে কক্সবাজার শহর এলাকায় ইয়াবা বহনকারী এক রোহিঙ্গা যুবক বলেন, “একবার ঠিকমত মাল (ইয়াবা) নিতে পারলে এক থেকে দেড় হাজার টাকা পাওয়া যায়। সপ্তাহে যদি দুইবার নিতে পারি তবে বেশকিছু টাকা জমে।”
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাম্প্রতিক তৎপরতার কারণে ইয়াবা বহন ‘সাময়িক বন্ধ’ আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বদ্দারা (মহাজন) সব পালিয়ে আছে। এ কারণে এখন মাল টানা বন্ধ।”
অনিবন্ধিত লেদা (হ্নীলা, টেকনাফ) শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা হাসিনা বেগম ও নূর হাসিনা বর্তমানে কক্সবাজার কারাগারে রয়েছেন। গত মাসে এদের দুজনকে ইয়াবাসহ আটক করে পুলিশ।
কুতুপালং শিবিরে অবস্থানরত তাদের স্বজনরা জানান, মূলত টাকা আয়ের জন্যই ইয়াবা বহন করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন তারা। অনেক রোহিঙ্গাই এখন এ কাজ করছে।
টাকা আয়ের এ উপায় হিসেবে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ উভয়ই অভিনব কায়দায় ইয়াবা বহন করছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভেতরে করেও ইয়াবা বহন করছে রোহিঙ্গারা। এছাড়া পেটের নীচে ব্যাগ লাগিয়ে গর্ভবতী সেজেও রোহিঙ্গা নারীদের দিয়ে ইয়াবা পাচার করানো হয়।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) টেকনাফ ৪২ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আবুজার আল জাহিদ বলেন, “রোহিঙ্গারা অত্যন্ত দরিদ্র। নিবন্ধিত ক্যাম্পের বাইরে যেসব রোহিঙ্গা আছেন তাদের থাকারও কোনো বৈধ অনুমতি নেই। সে কারণে খুব কম টাকায় ইয়াবা ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবহার করতে পারেন।”
এ কাজে জীবনের ঝুঁকি থাকলেও রোহিঙ্গাদের তাতে পিছুটান নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “অনেক সময় দেখা যায়, আমরা রোহিঙ্গা পাচারকারীকে ধাওয়া করলে সে ইয়াবাসহ নদীতে ঝাঁপ দেয়, যেখানে বাঙালি এমন অনেককে পেয়েছি যারা ইয়াবা রেখে পালিয়ে যায়।”
এভাবে পায়ে ইয়াবা বেঁধে তার উপর প্যান্ট টেনে দিয়ে এই মাদক বহন করা হয়।
এভাবে পায়ে ইয়াবা বেঁধে তার উপর প্যান্ট টেনে দিয়ে এই মাদক বহন করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে আসা কয়েকজন রোহিঙ্গাও টেকনাফ অঞ্চলে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছ্নে, যাদের প্রত্যেকেই স্থানীয় নারীদের বিয়ে করে বাংলাদেশে বসবাস করছেন।
এদের মধ্যে লামা বাজারের আব্দুল জলিল, সিলি বুনিয়া পাড়ার মো. গফফার এবং মো. ইয়াছিন আলীর নাম বলেছেন স্থানীয়রা।
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক বলেন, “এরা প্রত্যেকেই টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় জমি কিনে বসবাস করছে।”
মিয়ানমারে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দুই দশক আগে সে দেশের মুসলিম নাগরিক রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢোকা শুরু হয়। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এবং বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) তথ্য অনুযায়ী, কুতুপালং ও নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে নিবন্ধিত ৩০ হাজারসহ দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে।
এর বাইরে আরো প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে। তাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট নেয়ার ঘটনাও ধরা পড়েছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একাধিকবার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার দাবি জানানো হলেও তাতে সাড়া দেয়নি মিয়ানমার সরকার।



মন্তব্য চালু নেই