ইলিশ মৌসুমের শুরুতেই মেঘনা ও সাগরে জলদস্যু আতঙ্ক

ইলিশ মৌসুম শুরু হলেও ভোলাসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের জেলেদের জালে এখনো তেমন একটা ইলিশ ধরা পড়ছে না। অপরদিকে জেলেরা সাগরে নামতেই জলদস্যুদের অপহরণের শিকার হচ্ছেন। গত এক মাসে প্রায় দশটি মাছ ধরার ট্রলারে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া জলদস্যুরা কমপক্ষে ১৫ জেলেকে অপহরণ করেছে। প্রতি রজলের কাছে রথকে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছে দস্যুরা। সর্বশেষ অপহরনের ১৪দিন পর গত ১৬ জুন ১০ লাখ টাকা মুক্তিপন দিয়ে জলদস্যুদের কাছ থেকে মুক্তি পেয়েছেন পাথরঘাটার ছয়জন জেলে। ফলে প্রতি বছরের ন্যায় এবারো জলদস্যু আতঙ্ক বিরাজ করছে দক্ষিণাঞ্চলের জেলেপল্লীতে। এদিকে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে র‌্যাব-৮ এর সদস্যরা জেহাদ ঘোষণা করে অভিযান শুরু করেছেন। গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি মাসের ১৫ জুন পর্যন্ত র‌্যাবের সফল অভিযানে ছয়টি জলদস্যু বাহিনীর প্রধানসহ ১১জন সক্রিয় সদস্য বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে। এ সময় র‌্যাব সদস্যরা উদ্ধার করেছেন দস্যু পাস সহ বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সূত্রমতে,প্রতিবছর মেঘনা ও সাগরে একের পর এক জলদস্যু বাহিনীর হামলার শিকার হয়ে শত শত জেলে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। অনেকে ইলিশ ধরাও বন্ধ করে দিয়েছেন। জলদস্যুদের কাছ থেকে পঞ্চাশ থেকে লাখ টাকা মূল্যের আগাম ‘দস্যু কার্ড’ সংগ্রহ করা হলে জেলেদের অপহরণ করা হবেনা বলেও তাগিত দিচ্ছে দস্যুবাহিনী। গত ৩ জুন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সাগরের নারিকেলবাড়িয়া এলাকায় এফবি ফারজানা, এফবি এলাহী ভরসা ও এফবি আল্লাহর দানসহ বেশ কয়েকটি ট্রলারে হামলা চালিয়ে লুটপাট করেছে জলদস্যুরা। এ সময় অপহরণ করা হয় একাধিক জেলেকে। পরে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে অপহৃত জেলেদের ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে। এছাড়াও ইলিশ শিকার করতে গিয়ে মেঘনা ও সাগর থেকে জলদস্যুরা মুক্তিপণের দাবিতে ছয়জন জেলেকে ট্রলারসহ অপহরণ করে। অপহরনের ১৪দিন পর (১৬ জুন) অপহৃত জেলে লোকমান হোসেন, খলিলুর রহমান, ইব্রাহীম, আনিসুর রহমান, জাকির হোসেন ও সোলায়মান মাঝির পরিবারের সদস্যরা ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে তাদের মুক্ত করেন। অপহৃত জেলেরা জানান, জলদস্যু জাহাঙ্গীর বাহিনী সাগর থেকে তাদের ধরে নিয়ে সুন্দরবনের গহীনে আটক করে রেখে মুক্তিপণের দাবিতে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। পরবর্তীতে বিকাশের মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকা পেয়ে ১৬ জুন সকালে জলদস্যুরা তাদের বাগেরহাটের মংলার কোনো এক স্থানে এনে ছেড়ে দিয়েছে।
মুক্তি পাওয়া জেলেরা বলেন,সাগরে জলদস্যুদের উৎপাত কম ছিল। গত কয়েক বছর থেকে জলদস্যুদের উৎপাত বেড়ে গেছে। দস্যুরা নতুন নিয়ম বের করেছে। তাদের কাছ থেকে আগাম কার্ড সংগ্রহ করতে হবে নইলে গত কয়েক বছরের ন্যায় এবারো অপহরণ করা হবে। আর তাদের দাবিকৃত মুক্তিপণের টাকা না দিলে হত্যা করে সাগরে ফেলে দেবে। তাই চিন্তা করেছি সাগরে আর মাছ ধরতে যাব না,
এ বিষয়ে পাথরঘাটা কোস্টগার্ড স্টেশন কমান্ডার সুলতান আহম্মেদ বলেন, তাদের জনবল সংকট থাকলেও জলদস্যু দমনে তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
র‌্যাবের সফল অভিযান বরিশাল র‌্যাব-৮ এর উপ-অধিনায়ক মেজর আদনান জানান, বিগত সময়ে সুন্দরবন সংলগ্ন নদী বিধৌত অঞ্চলে একাধিক জলদস্যু বাহিনী বিপুলসংখ্যক নিরীহ জেলেদের অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়সহ হতাহতের ঘটনা ঘটিয়েছে। সম্প্রতি সময়ে দস্যুদের বিরুদ্ধে র‌্যাবের জেহাদ ঘোষণা করে র‌্যাব সদস্যসহ বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ অভিযান অব্যাহত থাকায় ক্রমেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় অঞ্চলে জলদস্যুদের অপতৎপরতা অনেকাংশে কমে গেছে। সূত্রমতে, বিগত সময়ে র‌্যাব-৮ এর অব্যাহত অভিযানে একাধিক জলদস্যু বাহিনীর প্রধান নিহত হবার পাশাপাশি উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ দেশী-বিদেশী অস্ত্র ও গোলাবারুদ। সর্বশেষ গত ১৫ জুন ভোরে সুন্দরবনের বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা রেঞ্জের কাতলারখাল এলাকায় র‌্যাবের সাথে আধাঘন্টাব্যাপী বন্দুকযুদ্ধে জলদস্যু জামাল বাহিনীর প্রধান নুরুজ্জামান জামাল ওরফে শাহ জামাল (৩৫) নিহত হয়েছে। এ সময় দস্যুদের ব্যবহৃত একটি পিস্তল, ৭টি একনলা বন্দুক, ২টি এয়ারগান, ৪টি কাটা বন্দুক, ৮টি দেশীয় তৈরি ধারালো অস্ত্র, ১৪টি বন্দুকের তাজা কার্তুজ, ২৭ রাউন্ড রাইফেলের গুলি, ৫৭টি এয়ারগানের গুলি, ৩৫টি বন্দুকের ফায়ারকৃত কার্তুজ, বিপুল পরিমাণ রশদ সামগ্রী, চাঁদা আদায়ের কার্ড ও তৈজসপত্র উদ্ধার করা হয়। নিহত জলদস্যু প্রধান নুরুজ্জামান জামাল ওরফে শাহ জামাল বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা গ্রামের রুস্তুম হাওলাদারের পুত্র। এরপূর্বে ১০ মে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের নন্দবালা খালের পূর্ব পার্শে¦র গহীন জঙ্গলের ভেতরে বসে র‌্যাবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে “মাইজ্যা বাহিনীর” দুইজন সক্রিয় দস্যু সদস্য নিহত হয়। ওইসময়ও বিপুল অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। ২৬ ফের্রুয়ারি সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কাতলারখালের দক্ষিণ পাশের গহীন জঙ্গলে র‌্যাবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে “সাগর-সৈকত’’ বাহিনীর তিন সদস্য। ৯ জানুয়ারি পশুর নদী সংলগ্ন সীমানার খালে দারোগা বাহিনীর উপ-প্রধান সগীর হাওলাদার নিহত হয়। এর আগে গতবছরের (২০১৪ সালের) ১১ নভেম্বর একই রেঞ্জের আন্ধারমানিক ফরেস্ট ক্যাম্পের উত্তর পার্শ্বে শ্যালাগাংস্থ আরুবারিয়া খাল এলাকায় বনদস্যু দারোগা বাহিনীর প্রধানসহ দুইজন ও একইবছরের ৮ অক্টোবর সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালাগাং এর মীরগামারিস্থ ফরেস্ট ক্যাম্পের পশ্চিম পার্শ্বে র‌্যাব-৮ এর সদস্যদের সাথে বন্দুকযুদ্ধে আউয়াল বাহিনীর দুই সদস্য নিহত হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে র‌্যাবের একাধিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জলদস্যু দমন ও আস্তানা সনাক্তকরণের জন্য জলদস্যু প্রবণ এলাকায় র‌্যাব-৮ এর একাধিক গোয়েন্দা টিম তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন।
মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা জেলেরা জানান, র‌্যাবের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার পর জলদস্যুরা সুন্দবনের শরণখোলা রেঞ্জের সুপতি, চান্দেশ্বর, কচিখালী, কটকা অঞ্চলের দরজার খাল, কাতলার খাল, খুনের খাল, বলেশ্বর নদী সংলগ্ন মোহনা এলাকার গহীন জঙ্গলের গাছের ওপর নিরাপত্তা চৌকি বসিয়ে আস্তানা গেড়েছে। তারা আরও জানান, মেঘনা ও সাগরের একেক এলাকায় একেকটি দস্যু বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমানে সুন্দরবন সংলগ্ন পশুর নদী, মংলা অঞ্চল, বলেশ্বর নদী সংলগ্ন শরণখোলা, পাথরঘাটা ও চরদুয়ানী এলাকার কয়েকটি দস্যু বাহিনী সক্রিয় রয়েছে।
জলদস্যুরা আইলার চেয়েও ভয়ঙ্কর আইলা, বন্যা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের চেয়েও দক্ষিণাঞ্চলের জেলেদের কাছে ভয়ঙ্কর রুদ্রমূর্তি হচ্ছে জলদস্যু। মেহেন্দীগঞ্জের ভাষানচর এলাকার জেলে পল্লীর বাসিন্দা বজলু বলেন, ঝড়-বন্যার তবুও আলামত পাওয়া যায়, কিন্তু জলদস্যুদের কোনো আলামত পাওয়া যায় না। হঠাৎ করে এসে দস্যুরা জেলেদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে যায়। আকাশে মেঘ নেই, গাঙ্গে বানের কিংবা তুফানের আলামত নেই। তবুও তার উৎকন্ঠা। না জানি কখন জলদস্যুরা হানা দিয়ে কেড়ে নেয় তার জীবন। এ চিন্তা শুধু বজলুর একারই নয়; উপকূলের জেলে পরিবারের সকলের । কারণ মেঘনা নদী থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ শিকারীদের পাশাপাশি ঘুরে বেড়ায় জলদস্যু নামের একদল হায়না। জেলেরা জানান, মেঘণা ও সাগর ও তৎসংলগ্ন নদীগুলোতে নৌ-ডাকাতির সাথে জড়িত জলদস্যুদের অধিকাংশই থাকে সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে। আরো বেশ কয়েকটি গ্রুপ থাকে লক্ষীপুর, মনপুরা ও চরফ্যাশনের দূরবর্তী কালকিনি এলাকায়। অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে ওইসব দস্যুরা নৌ-পথে চলাচল করে। গত দু’বছর ধরে ডাকাতির পরিবর্তে উপকূলের জলদস্যুরা সোমালিয়ার জলদস্যুদের মতো জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে আসছে। জলদস্যুদের কাছ থেকে টোকেন ক্রয় করে জেলেদের নদী বা সাগরে জাল রফলতে হয়। অসংখ্য গ্রুপ টোকেন বিক্রি করায় নির্দিষ্ট অংকের টাকায় এ টোকেন ক্রয় করেও অধিকাংশ সময় রক্ষা পাওয়া যায়না। এক গ্রুপের টোকেন ক্রয় করে মাছ শিকারে গিয়ে অন্য গ্রুপের হাতে পড়লে আর রক্ষা নেই। ফের অপহরণের মুক্তিপণ দিতে হচ্ছে জেলেদের।



মন্তব্য চালু নেই