ইতিহাসের ভয়াবহ ১০ ভূমিকম্প

ভূমিকম্প একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। কথাটি এ কারণেই বলা, প্রতি ৩০ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ভূমিকম্প হচ্ছে। তবে অনেক সময় মানুষ সেই ভূকম্পন টের পান না। ভূমিকম্পের মাত্রা যখন ৩-এর বেশি হয় তখনই কেবল টের পাওয়া যায়। ৭-এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্প একটি গোটা শহর গুড়িয়ে দিতে পারে। সৃষ্টি করতে পারে প্রলয়। প্রাণহানি ঘটতে পারে লাখ লাখ মানুষের। ইতিহাসে এমন অনেক ভয়াবহ ভূমিকম্পের নজির রয়েছে। মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞের দিক থেকে ১০টি ভয়াবহ ভূমিকম্প নিয়ে আজ আলোচনা করা হল।

জানুয়ারি ২৩, ১৫৫৬ সাল : ইতিহাসের পাতায় দিনটি লেখা রয়েছে এক কালো অধ্যায় হিসেবে। ভূমিকম্পে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছিল এই দিনে। চীনের শেনসি প্রদেশের রাজধানী জিয়ান থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূমিকম্পের ফলে এর কেন্দ্র থেকে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার, মতান্তরে ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কোনো কোনো জায়গার মাটি ভাগ হয়ে ঘর-বাড়ি নিচে চাপা পড়েছিল। কোথাও মাটি উত্থিত হয়েছিল আবার কোথাও বা মাটি ধ্বসে গিয়েছিল। এই ভয়াবহ ভূমিকম্পে প্রায় ৮ লাখ ৩০ হাজার মানুষ মারা যায়।

জুলাই ২৭, ১৯৭৬ সাল : হতাহতের দিক দিয়ে দ্বিতীয় ভয়ানক ভূমিকম্পটিও ঘটে চীনে, ১৯৭৬ সালের ২৭ জুলাই। ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল তাংশান। এর ভয়াবহতা বেইজিং পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। সরকারি হিসাব মতে মৃতের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার। কিন্তু অনেকের মতে তা ৬ লাখ ৫৫ হাজারেরও বেশি। গত ৪০০ বছরে এটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প।

আগস্ট ৯, ১১৩৮ সাল : ১১৩৮ সালের ৯ অগাস্ট সিরিয়ার আলেপ্পো শহর কেঁপে উঠে ভূমিকম্পের তীব্র কম্পনে। এর মাত্রা অবশ্য জানা যায়নি। আলেপ্পো নগরীর জনপদ ছিল ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত সবচেয়ে বড় জনপদ। আলেপ্পো থেকে প্রায় ২২০ মাইল দক্ষিণে দামেস্ক পর্যন্ত এর ভয়াবহতা অনুভূত হয়। শহরের ঘরবাড়ি ও পাহাড়ের পাথর ভেঙ্গে রাস্তায় এসে পড়েছিল। এই ভূমিকম্পে ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে নগরী হারিয়েছিল ইতিহাসের সাক্ষী অনেক মূল্যবান নিদর্শনও। শুধু আলেপ্পো নয়, সিরিয়ার উত্তর অংশ এবং তুরস্কের পশ্চিম অংশও সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

ডিসেম্বর ২৬, ২০০৪ সাল : ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় ৯.১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ১৯০০ সালের পর তৃতীয় সর্বোচ্চ এবং ১৯৬৪ সালের পরবর্তী সময়ে পৃথিবীতে সংঘঠিত হওয়া সবচেয়ে বড় মাত্রার ভূমিকম্প এটি। এই ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট সুনামিতে পূর্ব আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার ১৪টি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইন্দোনেশিয়ার প্রায় ২ লাখ ২৭ হাজার ৮৯৮ জন মানুষ মারা যায় অথবা নিখোঁজ হয় এবং ১.৭ মিলিয়ন মানুষ হয় ঘরছাড়া।

জানুয়ারি ১২, ২০১০ সাল : এ দিন হাইতিতে আঘাত হানে ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প। সরকারি হিসাব মতে এতে মৃতের সংখ্যা ২ লাখ ২২ হাজার ৫৭০ জন। শুধু তাই নয়, এই ভূমিকম্পের ফলে ৩ লাখ মানুষ আহত হয়, ১.৩ মিলিয়ন মানুষ ঘরছাড়া হয় এবং ৯৭ হাজার ২৯৪টি বাড়ি ধ্বংস হয়। এর ফলে সৃষ্ট সুনামিতেও হাইতির অনেক শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ডিসেম্বর ২২, ৮৫৬ সাল : ৮৫৬ সালের ২২ ডিসেম্বর ইরানের দামঘা শহরে আঘাত হানে এক ভয়ানক ভূমিকম্প। তখনকার সময়ে প্রযুক্তি এতোটা উন্নত ছিল না তাই এর মাত্রা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। দামঘা ছিল তখন ইরানের রাজধানী। ভূমিকম্পটি ইরানের উত্তর-পূর্বে প্রায় ২০০ মাইল পর্যন্ত কম্পিত করে এবং এতে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। প্রায় ২ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে।

ডিসেম্বর ১৬, ১৯২০ সাল : প্রাণহানির সংখ্যা বিচার করলে ১৯২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর চীনে ঘটে যাওয়া এই ভূমিকম্পটির স্থান হয় সাত নম্বরে। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির দিক বিবেচনা করলে এর অবস্থান আরো উপরে হবে। ৭.৮ মাত্রার এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল নিনক্সজিয়া প্রদেশের হাইউয়ান এলাকায়। ভূমিকম্পটি লিজুনবু-হাইউয়ান-গানয়ানছি এলাকা প্রায় ল-ভ- করে দেয়। কোথাও ভূমিতে ফাটল হয়ে লাখ লাখ ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়েছিল আর কোথাও বা ভূমি ধ্বসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল পুরো গ্রাম। কোন কোন নদী গতিহীন হয়ে পড়েছিল আবার কোন কোন নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে পড়েছিল। প্রায় ২ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই ঘটনায়।

মার্চ ২৩, ৮৯৩ সাল : দামঘা ভূমিকম্পের স্মৃতি তখনো মলিন হয়নি। মাত্র ৩৭ বছর পরই ৮৯৩ সালের ২৩ মার্চ ইরানের মানুষ সাক্ষী হয় আরো একটি প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পের। এই ভূমিকম্পে ইরানের উত্তর-পশ্চিম অংশের সবচেয়ে বড় শহর আরডাবিল এর অবর্ণনীয় ক্ষয়-ক্ষতি হয়। মারা যায় প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ। এর মাত্রা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।

সেপ্টেম্বর ১, ১৯২৩ সাল : ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিন জাপানের টোকিও-ইয়কোহামা অঞ্চলে আঘাত হানে ৭.৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প। এর কেন্দ্রস্থল ছিল কান্তো। এই ভূমিকম্পের ফলে ধ্বংস হয়ে যায় টোকিও-ইয়কোহামা এলাকা। ভূমিকম্প হওয়ার পর পরই আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত শুরু হয়। তাতে ৩ লাখ ৮১ হাজার ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আর ৬ লাখ ৯৪ হাজার ঘরবাড়ি আশিংক, অথবা সম্পূর্ণ পুড়ে যায়।

এটি ‘দ্য গ্রেট টোকিও আর্থকোয়েক’ বা ‘দ্য গ্রেট ফায়ার’ নামে পরিচিত। এতে মারা যায় ১ লাখ ৪২ হাজার ৮০০ জন মানুষ। এই ভূমিকম্পের প্রভাবে সাগামি সাগর উত্তাল হয়ে ওঠে। ৬ ফুট উঁচু ঢেউ উপকূলে আছড়ে পড়ে। এই ভূমিকম্পের কারণে বোসো দ্বীপ আনুভূমিকভাবে ১৫ ফুট সরে যায়।

অক্টোবর ৫, ১৯৪৮ সাল : ১৯৪৮ সালের ৫ অক্টোবর, তুর্কেমিনেস্তানের আশগাবাত এলাকাটি ভূমিকম্পে কম্পিত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭.৩। এর কম্পন ঐ এলাকার উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বের অনেক জায়গাতেও অনুভূত হয়। সরকারি হিসাব মতে এই ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার।



মন্তব্য চালু নেই