ইতিহাসের আয়নায় হজের জলসায়

হজ ও হজের সব বিধি-বিধান সেই সুদীর্ঘকাল ধরে একই রকম। এতে কোনো হেরফের বা পরিবর্তন নেই। রাজা কিংবা প্রজা কারোর জন্য কোনো ভেদাভেদ নেই।

ইসলামের আবির্ভাব তো বটেই, এরও আগে থেকে মানুষ হাজির হতো দলে দলে কাবার আঙিনায়, বর্ণ ও বংশের সব ভেদ ভুলে তারা শামিল হতো এক সামিয়ানায়। শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবী ইবরাহীমের (আ.) স্মৃতি অম্লান রেখে হজের নতুন পদ্ধতি শিখিয়ে গেছেন সবাইকে। চৌদ্দশ’ বছর ধরে সেটাই হজের নিয়ম, কাবায় হজ করতে আগ্রহী যে কাউকে সেসব নিয়মই মানতে হবে।

হজের এসব বাহ্যিক শরয়ী মাসআলা-মাসায়েলে কোনো পরিবর্তন নেই, এ কথা সত্য। কিন্তু প্রত্যেক হজযাত্রীর আবেগ ও হৃদয়ের ভাবে তারতম্য হয় এবং প্রত্যেকেই মনের একান্ত তরঙ্গে উদ্বেলিত হয়, ব্যক্তিভেদে হৃদয়ের দোলায় এ পার্থক্য অনস্বীকার্য। হজযাত্রার বাহন-অবলম্বনে পরিবর্তন এসেছে যুগে যুগে, হাজিদের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তবুও এ মানসিক ভাবাবেগ ও কাবার জন্য মুমিনের ভালোবাসায় কোনো ছেদ পড়েনি, হজের জন্য আগ্রহ বিন্দুমাত্রও কমেনি, ক্রমবর্ধমান হাজিদের সংখ্যাই এর উপযুক্ত প্রমাণ। অতীত থেকে বর্তমান, তাই তো হজ কাফেলায় চলমান অসংখ্য মুসলমান।

প্রতিটি হজের মৌসুমে অজস্র ঘটনা ঘটছে আবেগ-ভালোবাসার, সেসবের কয়টি আমরা জানি! আজকের এ লেখাটিতে আসুন আমরা ইতিহাসের অতীত হাজি সাহেবানদের কিছু ঝলক দেখে আসি।

দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমরের (রা.) হজ নিয়ে আমাদের একটি বর্ণনা শোনাচ্ছেন হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.)। তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন সম্মানিত সাহাবি। তিনি বলেন, আমরা হজরত উমরের খেলাফতের সূচনালগ্নে তার সঙ্গে হজ করেছিলাম। তিনি মসজিদে হারামে প্রবেশ করে হাজরে আসওয়াদের কাছে এসে থামলেন। তারপর পাথরটিকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি জানি, তুমি কেবলই একটি পাথর। কোনো ক্ষতি কিংবা উপকারের শক্তি তোমার নেই। আমি যদি রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে না দেখতাম যে, তিনি তোমাকে চুম্বন করছেন- তবে আমিও তোমাকে চুম্বন করতাম না।

হজের বিধি-বিধানে যুক্তি ও বিবেকের চেয়ে নবীপ্রেম ও আল্লাহর নির্দেশই যে মুখ্য, হজরত উমরের কথা ও কাজ এ সত্যের প্রমাণ হিসেবে উপযুক্ত।

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দীর্ঘদিনের খাদেম হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) যখন হজের জন্য ইহরামের পোশাক পরতেন, এরপর থেকে একেবারে হজের সব হুকুম শেষে হালাল হওয়া পর্যন্ত তিনি কারো সঙ্গে আর কোনো দুনিয়াবি কথা-বার্তা বলতেন না।

হজরত হোসাইন ইবনে আলী (রা.) যখন হজে রওনা হতেন তখন থেকেই তার চেহারার রং বদলে যেতো। তিনি অস্থির নির্বাক হয়ে যেতেন। লোকে তাকে জিজ্ঞেস করতো, কী হয়েছে আপনার? তিনি আতঙ্কিত কণ্ঠে বলতেন, আমার ভয় হচ্ছে, আমি যদি লাব্বাইক বলি আর ওপর থেকে আওয়াজ আসে, তোর উপস্থিতি আমার লাগবে না, তখন কী হবে? আল্লাহ পাকের ভয়ে প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয়তম দৌহিত্রের যদি অবস্থা এমন হয়, তবে আমাদের কেমন হওয়া উচিত?

হজে যাচ্ছেন হজরত উমরের ছেলে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর। পথে এক বেদুইন বৃদ্ধের সঙ্গে তার দেখা। হজরত ইবনে উমর তাকে সালাম দিলেন ও নিজের বাহন গাধা থেকে নেমে তাকে বসতে দিলেন। নিজের মাথার পাগড়ি খুলে ওই বৃদ্ধের মাথায় পরিয়ে দিলেন তিনি। হজরত ইবনে উমরের সঙ্গী ইবনে দীনার তাকে বললেন, এরা তো বেদুইন! সামান্য কিছু দিলেই তো লোকটি খুশি হয়ে যেতো, এ গাধা ও পাগড়ি দিয়ে দেওয়ার কি দরকার ছিল? হজরত ইবনে উমর বললেন, এ লোকটির সঙ্গে আমার বাবা উমরের ভালো সম্পর্ক ছিল। আর আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, বাবার ভালোবাসা ও সুসম্পর্কের মানুষদের সম্মান করা পিতার প্রতি অনুগত সন্তানের দায়িত্ব।

রাসুলের কথা মনে করে বাবার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে এক সাধারণ বেদুইন বৃদ্ধের জন্য ইবনে উমরের কি অপূর্ব শ্রদ্ধা!

একবার হজরত ইবনে উমর দেখলেন, একজন লোক এক বৃদ্ধা নারীকে তার পিঠে বসিয়ে কাবাঘর তাওয়াফ করছে। ইবনে উমর লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, এই নারী কে? লোকটির উত্তর, আমার মা। লোকটির পাল্টা প্রশ্ন, আপনি কি মনে করেন, এভাবে মাকে পিঠে বসিয়ে তাওয়াফ করিয়ে তার হক আমি আদায় করতে পারছি? হজরত ইবনে উমর লোকটিকে জানিয়ে দিলেন, তুমি যতবারই তোমার মাকে এভাবে তাওয়াফ করাও, এ সবগুলো কষ্ট তোমার জন্মের মুহূর্তে তোমার মা যে যন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন তার সমান হবে না। আর বাকি জীবনের প্রতিপালন ও অন্য সব কষ্ট তো দূরের কথা!

হজের সফরে দান ও উদারতার বিস্ময়কর দৃশ্য দেখা যেতো হজরত আব্দুল্লাহ বিন জাফরের বেলায়। তিনি নিজে হেঁটে আরাফাতের উদ্দেশে রওনা হতেন ও সেখানে গিয়ে তার ৩০ জন দাসকে মুক্ত করে দিতেন। এ মুক্ত ৩০ জন গোলামের যাওয়ার জন্য তিনি ৩০টি বাহনের ব্যবস্থা করতেন ও প্রত্যেককে ৩০ হাজার দিনার করে দান করতেন। তারপর বলতেন, এদের সবাইকে আমি আল্লাহর জন্য মুক্ত করে দিলাম। হয়তো তিনি এর বিনিময়ে আমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দান করবেন। হজের কল্যাণ ও বরকতের পবিত্র মৌসুমকে কাজে লাগিয়ে এভাবেই তিনি পরকালের মুক্তির জন্য আকুল হতেন পরম দয়াময়ের কাছে।

মারুফ আলকাজি নামে একজন বর্ণনা করেছেন, আমাদের হজ যাত্রায় সঙ্গীদের মধ্যে তুর্কমানের একজন অধিবাসী ছিলেন। সবাই যখন কেঁদে অস্থির হয়ে আল্লাহর কাছে দুআ-প্রার্থনায় নিমগ্ন হতেন, তখনও তিনি চুপ করে নির্বাক বসে থাকতেন। সবাই যেভাবে সুন্দর সুন্দর শব্দ ও বাক্যের মিশেলে দুআ উচ্চারণ করছে, এ লোকটি এসব পারতেন না বলেই নীরব হয়ে বসে থাকতেন। কিন্তু একদিন তিনি হাত উঠালেন ও গভীর অনুশোচনায় আবেগ মিশিয়ে দুআ করলেন, হে আল্লাহ! হে দয়াময়! আমি তোমার কাছে চাওয়ার মতো করে চাইতে পারি না, আমার এ অক্ষমতা তুমি তো জানো। হজের এ ময়দানে সমবেত সবাই যা চাচ্ছে, তুমি আমাকে সেগুলো দান করো।’ ওই হজেই বেশ কয়েকজন নেককার বুযুর্গ স্বপ্নে দেখেছেন, আল্লাহ পাক সেই বছর সবার হজ কবুল করেছেন কেবল এই তুর্কমানি লোকটির কারণে। কারণ তিনি নিজের অক্ষমতা এবং তুচ্ছতা ও অসহায়ত্ব তুলে ধরে পরম দয়াময়কে ডেকেছিলেন হৃদয় থেকে।

হজের সফরে প্রতিটি পদক্ষেপে পূণ্য অর্জনের অফুরন্ত সুযোগ রয়েছে। আমাদের পূর্বসুরি বুযুর্গরা সেইসব সুযোগকে কাজে লাগাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করতেন না। নিজের কঠিন ইবাদত ও সাধনার পাশাপাশি অন্যদের সেবা ও খেদমতে তারা নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেন। কোনোভাবেই যেন হজের একটি মুহূর্তও নেকি অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকতেন।

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) যে বছর হজে যেতেন, সেই বছর তিনি তার শহরবাসীকে ডাকতেন। সবাই সমবেত হলে তিনি জিজ্ঞেস করতেন, এ বছর তোমাদের মধ্যে কে কে হজে যেতে আগ্রহী? ইচ্ছুক ব্যক্তিরা হাত উঠালে তিনি তাদের কাছ থেকে হজ যাত্রার খরচ উঠাতেন ও সেসব একটি বাক্সে ভরে রাখতেন। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে আগ্রহী সবাইকে নিয়ে হজের উদ্দেশে রওনা হতেন। নিজের হাতে সবার যাবতীয় খরচ দিতেন। হাজিদের জন্য তিনি সর্বোত্তম মানের খাবারের আয়োজন করতেন। লোকজন ভাবতো, এটা তো তাদেরই জমাকৃত খরচ থেকে ব্যয় করা হচ্ছে। তারাও নিঃসঙ্কোচে সেসব ব্যয় করতেন। হজ শেষে যারা নিজেদের পরিবার ও স্বজনদের জন্য হাদিয়া কিনতে চাইতেন, তিনি সেসবও কিনে দিতেন। তারপর সবাইকে নিয়ে যখন নিজের শহরে ফেরত আসতেন, তখন আবারও সবাইকে নিয়ে আহার আয়োজন করতেন। সম্মিলিত খাবার-দাবারের পর সবাইকে বসিয়ে ওই বাক্সটি এনে খুলতেন ও যাত্রার আগে প্রত্যেকের জমাকৃত দিনার-দিরহামগুলো ফেরত দিতেন। এ সফরের পুরো সময় সবার জন্য যতো খরচ হয়েছে- সেগুলো ছিল হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারকের পক্ষ থেকে সবার জন্য হাদিয়া। অথচ তার সঙ্গীরা ফিরে আসার আগ পর্যন্ত এ রহস্য জানতো না।

হজের সফরে নিজেকে আল্লাহর জন্য বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে অপার্থিব স্বাদ ও আনন্দ খুঁজে পেতেন আগেরদিনের বুযুর্গরা। এমনকি তারা হজের সময় ঘুমাতেও লজ্জাবোধ করতেন। ভাবতেন, ঘুমালেই তো এটুকু সময় চলে গেল দয়াময়ের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে।

জামরা বিন রাবিয়া বলেন, আমরা ইমাম আওযায়ির সঙ্গে হজ করেছি। আমি কখনোই তাকে বিছানায় শুতে দেখিনি। না দিনে, না রাতে। যখন তার নিদ্রা প্রবল হতো, তখন কোনো খুঁটিতে হেলান দিয়ে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিতেন। হাদিস শাস্ত্রের আরেকজন প্রখ্যাত ইমাম মাসরুক হজের সময় যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তেন, তখন তিনি সিজদা অবস্থায় ঘুমাতেন। যেন এটুকু সময়ও আল্লাহর জন্য সিজদায় অবনত হয়ে থাকা যায়।

মহান আল্লাহর দয়া ও করুণা প্রাপ্তির একটি অন্যতম শর্ত হলো মনের ভেতর সুগভীর আস্থা, ভালোবাসা ও বিশ্বাস। আল্লাহ পাকের ক্ষমা নিয়ে যার মনে সংশয় ও সন্দেহ, সে চিরকালই পরম করুণময়ের নেয়ামত থেকে বঞ্চিত। এজন্যই ইবনে মুবারক (রহ.) বলেন, আমি আরাফাতের দিন সন্ধ্যায় হজরত সুফিয়ান সাওরির কাছে গেলাম। দেখি, তিনি ক্লান্ত ও ইবাদতে নিমগ্ন। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আজকের এ সুবিশাল জমায়েতে সবচেয়ে হতভাগা কে? হজরত সুফিয়ান সাওরি (রহ.) বললেন, যে ব্যক্তি ভাবে যে আল্লাহ পাক তাকে মাফ করবে না, সে-ই আজকের সবচেয়ে বড় হতভাগা, দুর্ভাগা।

যুগ-যুগান্তরে এমনই নানা বর্ণিল সাধনা ও আশা-ভালোবাসার আবেগে হজ প্রাণবন্ত হতো, হয়তো এখনও হচ্ছে। আল্লাহর আশেকান হাজি সাহেবানরা ছুটে যাচ্ছেন কাবার আঙিনায়, মন ভরে ডাকছেন আল্লাহকে, পরম ভালোবাসায়। প্রতিবছর কত অজস্র মানুষ চুম্বন করছেন ওই কালো পাথরে, ভাগ্যবান হয়ে শামিল হচ্ছেন আরাফাত-মিনা-মুজদালিফার সামিয়ানায়।



মন্তব্য চালু নেই