আ.লীগ সরকারের সেরা সাফল্য ছিটমহল বিনিময়

টানা আট বছর ধরে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার। রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সফল হওয়ার জন্য এটি নিঃসন্দেহে দারুণ এক সুযোগ। এই সুযোগ কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি? টানা সরকার পরিচালনার আট বছরে দলটির ব্যর্থতা আছে বটে, তবে সাফল্যও কম নয়। রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ সময়ে সাফল্যের হিসাবখাতায় তালিকার সামনেই রাখতে হবে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ৬৮ বছরের পুরনো ছিটমহল সমস্যার সমাধান।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলছেন, ছিটমহল বিনিময় তথা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ভূমি বিনিময়, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তারা বলছেন, দুই দেশের জন্য ছিটমহল বিনিময়ের ঘটনা শুধু কূটনীতিক বা রাজনৈতিক সাফল্যই নয়, মানবিকতার মানদণ্ডেও এক বিরাট অর্জন।

২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহল বিনিময় চুক্তি কার্যকর হয়। দীর্ঘদিনের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয় ভারত ও বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটমহলের ৫৫ হাজার মানুষ। বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতের ছিটমহলগুলো বাংলাদেশের ভূমি হিসেবে এবং ভারতের ভেতরকার বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো ভারতের অংশ হিসেবে সরকারিভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছিল ভারতের ১১১টি ছিটমহল। এসব ছিটমহলের ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর ভূখণ্ড বাংলাদেশের মালিকানাভুক্ত হয়। বাংলাদেশের লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলায় ছিল এসব ভূখণ্ডের অবস্থান। ২০১৫ সালের ৬ থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত ছিটমহলে দুই দেশের যৌথ জনগণনা মতে, এসব ভূখণ্ডে মোট বাসিন্দা ৪১ হাজার ৪৪৯ জন। তাদের মধ্যে মাত্র ৯৭৯ জন তাদের ভারতের নাগরিকত্ব বহাল রেখে ভারত ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। এই ৯৭৯ জন ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ভারত ফিরে যাওয়ার কথা ছিল।

প্রায় সাড়ে একচল্লিশ হাজার ভারতীয় ছিটমহলবাসীর মধ্যে মাত্র ৯৭৯ জনের ভারত যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেখেও বাংলাদেশের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ নিজেদের দেশ নিয়ে আনন্দ ও সুখানুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি ভারতীয় ছিটমহলবাসীদের আস্থা এবং ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে তখন অনেক মানুষ ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে নিজেদের অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।

অন্যদিকে, ছিটমহল বিনিময়ের অংশ হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের মালিকানা পেয়েছে ভারত। এর ফলে এসব ছিটমহলের সাত হাজার ৭১০ দশমিক শূন্য দুই একর ভূখণ্ড পায় ভারত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কুচবিহার জেলার এসব ছিটমহলে ১৪ হাজার ২১৫ জন বাসিন্দা নিজেদের অভ্যস্ততার জন্য ভারতের নাগরিক হয়ে থেকে যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করে।

২০১৫ সালে ছিটমহলগুলোর অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের যে নতুন জীবনের সূচনা হয়েছে, এই অতি প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াটি সম্পাদিত হতে পারত বহু আগেই, যদি প্রতিবেশী ভারতের সদিচ্ছা থাকত। সেই ১৯৭৪ সালে ভূমি বিনিময় নিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির মধ্যে একটি চুক্তি হয়, যা ইতিহাসে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নামে পরিচিত। বাংলাদেশ চুক্তিটি অনুসমর্থন করলেও ভারত তখন তা করেনি। ২০১১ সালে সীমান্ত চুক্তির সঙ্গে সই হয় প্রটোকল। অনিবার্য হয়ে পড়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রটোকলসহ সীমান্ত চুক্তি কার্যকর করতে ভারতের সংবিধান সংশোধন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বর্তমান সরকার দেশটির পার্লামেন্টে সর্বসম্মতভাবে সংবিধান সংশোধনে সমর্থ হয়। এরপরই প্রটোকলসহ সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পথ খোলে।

রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারভিত্তিক বর্তমান সভ্য বিশ্বে ছিটমহলের অস্তিত্ব ছিল বিশ্বমানবতার জন্য এক লজ্জাজনক অধ্যায়। ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়ায় সফল হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার হাজার হাজার মানুষের জীবনে যেমন স্বস্তি এনেছে, তেমনি নতুন প্রজন্মকে দিয়েছে অসীম সম্ভাবনার এক উর্বর ক্ষেত্র।

যাদের বাড়ি ছিটমহলে ছিল কিংবা যারা ছিটমহল সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখেন, তারা অনুধাবন করতে পারবেন, কী অবিশ্বাস্য বিড়ম্বনা, কষ্ট আর জটিলতার জীবন-যাপন ছিল সেখানে! ৬৮ বছর ধরে ছিটমহলবাসীরা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থেকে ভারতের লোক আর ভারতের ভূখণ্ডে থেকে বাংলাদেশের লোক বলে বিবেচিত হতো। নিজ দেশে পরবাসী ছিলেন তারা। আর জীবন ছিল যেন জেলখানায় বন্দি।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ধর্মের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশকে ভাগ করেছিল ভারত ও পাকিস্তান নামের দুই দেশে। আর দিয়ে গিয়েছিল অদ্ভুত সব ছিটমহল। এরপর ভাষার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পাকিস্তানের বাঙালিরা ১৯৭১ সালে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে নিজেদের স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করে ফেলল। উপমহাদেশে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নামের তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলেও ব্যতিক্রম ঘটল কেবল ছিটমহলবাসীদের জীবনে। তারা নামেই শুধু ভারতীয় কিংবা বাংলাদেশি। রাষ্ট্র নাই, প্রশাসন নাই। শিক্ষা কিংবা স্বাস্থ্য- জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই এদের ছিল না কোনো সেবা। তাদের জন্ম নেয়াই যেন অভিশাপ। জীবনের কোনো গন্তব্য নেই, আনন্দ নেই, পরিকল্পনা নেই। যেন কোনোমতে বেঁচে থেকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা। এমনই অনিশ্চিত, আনন্দহীন জীবনের অবসান ঘটিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার।

আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, শুধু আট বছরের ইতিহাসে নয়, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসেই ছিটমহল বিনিময়ের ঘটনা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা হিসেবে যুগ যুগ ধরে বিবেচিত হবে।

তিনি বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিটমহলবাসীর দুঃখ অনুভব করে তাদের সব সংকট মোচনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা এই মহান নেতাকে হত্যা করায় তিনি এর সফল বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা জাতির জনকের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেছেন।’

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি বলেন, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বিশাল সমুদ্রসীমা বিজয়ের পর ছিটমহল বিনিময়ের ঘটনায় সরকারের সাফল্য প্রমাণ করে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক শক্তিশালী।

দীপু মনি বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ বন্ধুরাষ্ট্র। ছিটমহল বিনিময় দুই দেশের জন্যই দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণ বয়ে আনবে। পররাষ্ট্র, রাজনীতি কিংবা মানবিক সাফল্য, যা-ই বলি না কেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময় ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল ঘটনা হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে।’

ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময়ে বাংলাদেশের সাফল্য কীভাবে দেখছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ছিটমহল বিনিময় আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম বড় অর্জন। দুই দেশ নিজ নিজ সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে ছিটমহল বিনিময় করেছে। দুই দেশই এখানে জয়ী।’খবর ঢাকাটাইমসের।



মন্তব্য চালু নেই