সিদ্ধান্ত আছে বাস্তবায়ন নেই

আসতে-যেতে দুর্ভোগ

যোগাযোগ, রেল ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যৌথ সিদ্ধান্ত আছে, বাস্তবায়ন নেই। সমন্বয়হীনতায় আন্তমন্ত্রণালয় সিদ্ধান্তগুলো এভাবেই পড়ে থাকে। এটা এখন সাধারণ চিত্র হয়ে গেছে। কিন্তু এ কারণে ঈদে ঘরে ফিরতে মানুষ যেমন দুর্ভোগ আর বিড়ম্বনার শিকার হয়েছে তেমনি আবার কর্মস্থলে ফিরতে একই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তারপরও সব কিছু উপেক্ষা করে কর্মজীবী মানুষ ঢাকামুখি হতে শুরু করেছে।

গত ৪ জুলাই (রমজানের প্রথম শুক্রবার) রাজধানীর রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়: বাস, লঞ্চ ও ট্রেনের ছাদে অতিরিক্ত যাত্রী বহন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা যাবে না। কিন্তু এর কোনটিও কার্যকর করা হয়নি।

ঈদের আগের দিন গত সোমবার সকাল ১০টায় গাবতলী বাস টার্মিনালে দেখা গেছে, গাবতলী টু পাটুরিয়া সড়কে পদ্মা লাইনের ড্রাইভার, কন্ট্রাকটর ও হেলপার হাঁকডাক দিয়ে বলছেন, বাসের ভেতর ২০০, ছাদে ১০০, বাসের বামপারে ঝুলে ৫০ টাকা দিয়ে পাটুরিয়া যাওয়া যাবে। নিয়মিত ভাড়া হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। সেখানে প্রায় তিন গুণ বেশি ভাড়ায় এভাবে মানুষকে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরতে বাধ্য করা হয়েছে। শুধু পদ্মা লাইনই নয়, যাত্রী সেবা, শুভযাত্রাসহ সব পরিবহনে এই চিত্র দেখা গেছে।

অপর দিকে লঞ্চ ও ট্রেনের চিত্র ছিল আরো ভয়াবহ। ঠিক গাবতলী আসার পথে গত বৃহস্পতিবার পাটুরিয়া ঘাটেও একই চিত্র। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই এসব ঘটনা ঘটছে। কোনো কোনো যাত্রী অভিযোগ করলে তারা বলেছে, আমরা আছি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায়। ভাড়ার ব্যাপারে কিছুই করতে পারবো না।

অথচ আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কড়া ভাষায় বলেছিলেন, ‘কোনো অবস্থাতেই বাসের ছাদে যাত্রী নেয়া ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা যাবে না। কেউ অনিয়ম করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

নৌ-পরিবহন মন্ত্রী মো. শাজাহান খান তখন বলেন, ‘লঞ্চের ছাদে ও সরকারি তালিকার বাইরে কেউ বেশি ভাড়া রাখলে ওই লঞ্চ মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ কিন্তু এর কোনোটারই বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। বরাবরের মতো মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বেশি ভাড়া দিয়ে বাড়ি ফিরেছে। মন্ত্রী কিন্তু হেলিপ্যাডে চড়ে নৌ-পথ পরিদর্শন করেছেন। গণমাধ্যমে বেশ কাভারেজও পেয়েছে!

অপরদিকে রেলপথ মন্ত্রী মো. মুজিবুল হক বলেছিলেন, ‘শত ভাগ যাত্রী সেবা দিতে রেল প্রস্তুত।’ কোনো অবস্থাতেই রেলের ছাদে যাত্রী বহন না করার অঙ্গীকার করেন তিনি। কিন্তু ঈদের আগের কয়েক দিন উত্তরবঙ্গগামী ট্রেনগুলোর যেসব ছবি বিভিন্ন পত্রিকায় ও টেলিভিশনের প্রচার করা হয়েছে সেসব দেখলেই বাস্তব চিত্রটা বুঝা যায়।

এতো গেল ঈদ করতে রাজধানী ছেড়ে বাড়ি যাওয়ার ঝক্কি। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ার ওই একই দায়িত্বহীনতায় একই ধরনের দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন কর্মস্থলে ফেরা মানুষ।

ঈদ শেষে ফিরতে হবে ঢাকায়, কিন্তু এই পথে টিকিট সঙ্কটের কারণে বিড়ম্বনায় যাত্রীরা। কি বাস, কি ট্রেন, টিকিট মিলছে না কোথাও। এতে সময়মত কর্মস্থলে উপস্থিত হতে না পারার শঙ্কা সবার মনে।

টিকিটের খোঁজে কিছুক্ষণ পর পর কাউন্টারে আসছেন যাত্রীরা। কিন্তু এতো চাহিদা পূরণ সম্ভব না, বলছে পরিবহন কর্তৃপক্ষ।

জামালপুর থেকে ঢাকাগামী তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও অগ্নিবীনা ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রি শুরু হয় ঈদের আগের দিন। ৭২০টি আসনের জন্য ভোর থেকে লাইনে দাঁড়ায় মানুষ। জনপ্রতি টিকিট দেয়া হয় দুটি করে। কিন্তু এক ঘণ্টা পর জানানো হয়, টিকিট শেষ। আর এই ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে যাত্রীরা।

এক ঘণ্টায় সব টিকিট কীভাবে শেষ হলো সে বিষয়ে রেলের কর্মকর্তারা কিছু বলতে রাজি হননি। নীলফামারী থেকে ঢাকাগামী বাসের ফিরতি টিকিট শেষ হয়ে গেছে ঈদের আগেই। তবু কাউন্টারে ভিড় করেন যাত্রীরা। গত রোববার থেকে ট্রেনের আগাম টিকিট ছাড়ার ঘণ্টাখানেক পড়েই শেষ হয়ে যায়।

এদিকে ঈদের বিএনপির সরকার পতন আন্দোলন ও আওয়ামী লীগের তা প্রতিহতের ঘোষণায় আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কায় শিশুদের স্কুল ও ভোগান্তির ভয়ে অনেকে ঈদের পরের দিন ভোর থেকে ঢাকা ফিরতে শুরু করেছেন। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই রাজধানীর রেলস্টেশন, লঞ্চ ও বাস টার্মিনালে বাড়ি ফেরত মানুষের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে পথে পথে ভোগান্তি পেরিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক যাত্রী।

ঈদ শেষে গাবতলী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ক’দিন ফাঁকা ফাঁকা থাকলেও বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই এ টার্মিনাল বেশ জমজমাট হয়ে উঠতে দেখা গেছে। দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, যশোর, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন জেলা থেকে অসংখ্য মানুষ ঢাকায় আসতে শুরু করেছে এই দু’টি টার্মিনাল দিয়ে।

এদিকে কমলাপুর রেল স্টেশনেও ছিল ঢাকা ফেরত মানুষের ভিড়। চট্টগ্রাম, সিলেট ,রাজশাহী, খুলনাসহ বিভিন্ন স্টেশন থেকে আসা প্রতিটি ট্রেনে ছিল ভিড়। আগামী শুক্রবার ও শনিবার কমলাপুর স্টেশনে ভিড় আরও বাড়বে বলে জানান সংশ্লিষ্ট রেল কর্মকর্তারা।

বৃহস্পতিবার ভোর থেকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঢাকামুখি মানুষের স্রোত দেখা গেছে। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত ১০টি লঞ্চ ঘাটে এসেছে ও ৮টি লঞ্চ ঘাট ছেড়ে গেছে।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঢাকামুখি ও ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষের চাপ বাড়ছে। ঈদের আমেজ কেটে গেলেও যাত্রী হয়রানি, লঞ্চের ছাদে অতিরিক্ত যাত্রী ও অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার অভিযোগ আগের মতোই। পাশাপাশি যাত্রী বেশে ছিনতাইকারী, অজ্ঞানপার্টির দৌরাত্ম্য কমেনি।

বরিশাল থেকে ছেড়ে আসা সম্রাট-২ এর যাত্রী আসলাম উদ্দিন পরিবার নিয়ে সদরঘাটে পৌঁছে রীতিমত বিড়ম্বনায় পড়েন। তিনি জানান, বাচ্চারা ছোট বলে বিড়ম্বনা হচ্ছে। আগে ফেরার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ঈদের দশ দিন আগে স্ত্রী ও বাচ্চারা গ্রামে গেছে। বাচ্চাদের লেখাপড়া ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে পারে বলে আগে ফিরলাম।’

চাঁদপুর থেকে ছেড়ে আসা এমডি মিতালী-২ যাত্রী ব্যাংকার মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভোগান্তি ও রাজনৈতিক সহিংসতার ভয়ে আগে ফিরলাম। ভাড়া বেশি নেয়া তো তাদের স্বভাব।’ লঞ্চে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেই বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল সূত্রে জানা যায়, এখান থেকে প্রতিদিন ৪৪টি রুটে ১৬০-৭০টি লঞ্চ চলাচল করে। ঈদের আগের দিন থেকে বিআইডব্লিউটিসি, লঞ্চ মালিক সমিতি বিশেষ লঞ্চের ব্যবস্থা করেছে।

সদরঘাট লঞ্চ মালিক সমিতি সভাপতি জানান, বৃহস্পতিবার রাত থেকে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। তবে কোনো প্রকার হয়রানি, অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

এদিকে ঢাকামুখি কোনো কোনো গাড়িতে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন অনেক যাত্রী।

আব্দুল কাদের নামে ফেনী থেকে আসা এক যাত্রী বলেন, ‘আমার কাছ থেকে ১শ’ টাকা ভাড়া বেশি নিয়েছে। অথচ কথা ছিল গাড়িতে বাড়তি কোন যাত্রী নেবে না। কিন্তু তারা ভাড়াও বেশি নিয়েছে, আবার বাড়তি যাত্রীও নিয়েছে। সব কিছুই বাস চালক ও হেলপারের ইচ্ছাতেই হচ্ছে।’

মাজিদুল হাসান নামে নোয়াখালী থেকে আসা অপর এক যাত্রী অভিযোগ করেন, ‘ভাড়া তো বেশি নিচ্ছেই, আবার কেনো বেশি ভাড়া দিতে হবে, এমন প্রশ্ন করলে বলছে, আপনি গাড়ি থেকে নেমে যান। যেহেতু আমাদের ঢাকায় আসতে হবে, তাই অনেকটা জিম্মি হয়েই তাদের বাসে চড়তে হয়েছে।’

তবে বাড়তি ভাড়া ও যাত্রী নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন সায়েবাদ বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ‘যাত্রীদের সব সুবিধা নিশ্চিত করতে আমরা তৎপর রয়েছি। কোন গাড়িতে বাড়তি ভাড়া ও অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া হচ্ছে না। তারপরেও যদি কারো বিরুদ্ধে আমাদের কাছে এমন অভিযোগ আসে, তাহলে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেবো।’



মন্তব্য চালু নেই