আ’লীগ সাধারণ সম্পাদক পদে কি আবারও সেই পুরনো মুখ? নাকি নতুন কেউ আসছেন?

এক-এগারোর পটপরিবর্তনের জটিল পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ে নেতৃত্বে আসেন সৈয়দ আশরাফ। শেখ হাসিনা ও আবদুল জলিল (সে সময়ের সাধারণ সম্পাদক) কারাবন্দি থাকাকালে জিল্লুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পালন করেন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। পরে ২০০৯ সালের ২৪ জুলাইয়ের জাতীয় সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফ। ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় সম্মেলনে আবারও একই পদে নির্বাচিত হন তিনি।

আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদে কি আবারও সেই পুরনো মুখ? নাকি নতুন কেউ আসছেন? দলের ভেতর নানা আলোচনা, গুঞ্জন। দলের একটি অংশ বলছে, জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফই বহাল থাকছেন তার পদে। তবে নেতাদের কেউ কেউ জোরের সঙ্গে বলছেন, পরিবর্তন আসছে। দলের সভাপতিম-লীর সদস্য এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আর কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষিবিষয়ক সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকের নাম এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় আছে বলেও দাবি করছেন নেতারা। জাতীয় সম্মেলনে সারা দেশ থেকে আসা কাউন্সিলরদের ভোটে দলের নেতৃত্ব নির্বাচনের বিধান আছে। ভোটের মাধ্যমে এই নেতৃত্ব নির্বাচনের কথা থাকলেও সভাপতি পদে শেখ হাসিনা যে আবার নির্বাচিত হচ্ছেন, তা বলাই যায়। কারণ, দলের ভেতর তাকে চ্যালেঞ্জ করে অন্য কারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম আভাষ নেই।

কিন্তু দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। এ পদে আসার জন্য নানামুখী তদবিরও চলছে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে দলের সভাপতির ওপর। একমাত্র তিনিই জানেন কী হতে যাচ্ছে আগামী জাতীয় সম্মেলনে। তবে জাতীয় সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা হলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী এই সম্মেলন হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন নেতারা। কারণ, আওয়ামী লীগ ২৮ মার্চ জাতীয় সম্মেলনের ঘোষণা দিলেও ওই সময় দেশে দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সে ক্ষেত্রে জাতীয় সম্মেলন পেছাতেও পারে বলে জানিয়েছেন নেতারা।

সৈয়দ আশরাফের হ্যাটট্রিক?

দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদটি বরাবরই গুরুত্ববহ। দল তো বটেই সারা দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণেও এই পদের একটি ভূমিকা আছে। সভাপতির সঙ্গে তার আলোচনা-পরামর্শে নেওয়া হয় সিদ্ধান্ত। আর আওয়ামী লীগ কী করে তার ওপর নির্ভর করে কৌশল বা সিদ্ধান্ত নেয় অন্য রাজনৈতিক দলও। এ কারণে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদটি নিয়ে বরাবর এই দলের পাশাপাশি অন্য রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতি সংশ্লিষ্ট নানা সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে থাকে নানা জিজ্ঞাসা-কৌতূহল। আর বরাবরই এই পদে আওয়ামী লীগ অবিতর্কিত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের নিয়ে এসেছে।

সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি আছে সৈয়দ আশরাফের। দুর্নীতি-ক্ষমতার অপব্যবহারের কোনো অভিযোগও নেই তার বিরুদ্ধে। তাই এবারও শেখ হাসিনার পছন্দের তালিকায় সৈয়দ আশরাফ আছেন, বলছেন দলের নেতাদের একটি অংশ। তবে দলে সৈয়দ আশরাফের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে আছে সমালোচনা-ক্ষোভ। সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের দূরত্বের বিষয়টিও নতুন নয়। নেতা-কর্মীরা সমস্যায় পড়ে অনেক সময় সঠিক দিকনির্দেশনা পান না। দলীয় সূত্র জানায়, এসব দিক বিবেচনায় সৈয়দ আশরাফের বিকল্প খোঁজার চিন্তাও আছে দলে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল দলের সাধারণ সম্পাদক পদও হারাতে বসেছেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত আর সেটি হয়নি তখন।

যদি আশরাফ না হন তবে কে?

এবার যদি পরিবর্তন আসে, তাহলে কে আসছেন নেতৃত্বে? সর্বাগ্রে আলোচনায় আসছে ওবায়দুল কাদেরের নাম। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের দুই দফা সভাপতির পদ সামলেছেন তিনি। রাজনীতিক হিসেবে তার সক্রিয়তা নিয়েও প্রশ্ন নেই। তবে কথা বেশি বলেন এমন অভিযোগ আছে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর ব্যাপারে। অতিরিক্ত কথা বলার কারণে বিভিন্ন সময় সমালোচনার দায়ও এড়াতে পারেননি এই মন্ত্রী। একসময় দলের সভাপতি শেখ হাসিনার বেশ আস্থাভাজন ছিলেন ওবায়দুল কাদের। বিশ্বাসীও ছিলেন বটে। এক-এগারোতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় অনেকের মতো তিনিও বিতর্কিত হন। সেই থেকে শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্কের বোঝাপড়ায় দূরত্ব বাড়লেও সাধারণ সম্পাদক হওয়ার বাসনা থেকে দূরে সরেননি দলের সাবেক এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। বরং বেশ কয়েকবার দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার চেষ্টা করেছেন, এখনও করে যাচ্ছেন।

ওবায়দুল কাদেরের অনুসারী-অনুগামীরা মনে করেন, সাংগঠনিক নানা কর্মকা-ে ওবায়দুল কাদেরের ভূমিকার জন্য তিনি সাধারণ সম্পাদক হওয়ার যোগ্য। গত ডিসেম্বরে পৌরসভা নির্বাচন পরিচালনায় দলের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনের সময় থেকেই দলীয় সভাপতির কার্যালয়েও সময় দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। পদপদবি না পাওয়া মনঃক্ষুণ্ন সাবেক ছাত্রনেতাদের রাজনীতির মাঠে সক্রিয় করছেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সম্মেলনের তারিখ ঘোষণার পরই দলে আরও বেশি সক্রিয় হন ওবায়দুল কাদের। দলীয় সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে তিনি নেতা-কর্মীদের নিয়মিত সময় দিচ্ছেন। পাশাপাশি দলের প্রয়াত ও অসুস্থ নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর নিতে কখনও হাসপাতালে কখনও বাসভবনে ছুটে যাচ্ছেন। সম্প্রতি দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহাবউদ্দিন ফরায়েজির কবর জিয়ারত ও তার পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিতেও তৃণমূলে ছুটে গেছেন তিনি। এছাড়া চলতি মাসেই পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর ছেলের মৃত্যুতে শোকাহত পরিবারের পাশে দাঁড়াতেও দেখা গেছে তাকে। গত দুই সম্মেলনেও তিনি সাধারণ সম্পাদক পদের প্রত্যাশী ছিলেন। এবার তার প্রত্যাশা পূরণ হতে যাচ্ছে, এমন দাবি করছেন তার অনুসারীরা।

দলের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক আছেন আলোচনার কেন্দ্রে। ব্যক্তি হিসেবে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির এই নেতা বিগত সময়ে দলের কর্মকাণ্ডে বেশ সক্রিয় ছিলেন। তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ-সম্পর্ক ভালো। সর্বশেষ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ওই নির্বাচনে ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ সফলতার সঙ্গে মিটিয়েছিলেন তিনি। অধিকাংশ ওয়ার্ডে দল সমর্থিত একক কাউন্সিলর প্রার্থী নিশ্চিত হয়েছিল এ নেতার দূরদর্শী সাংগঠনিক নেতৃত্বের মধ্যে দিয়ে। শুধু নির্বাচন নয়, ঢাকা দক্ষিণের সিটি করপোরেশনের অধীনে সব থানা ওয়ার্ডের নেতা-কর্মীরা সুসংগঠিত হয়ে দলীয় সমর্থিত প্রার্থীর বিজয়ে কাজ করার পেছনে তার অবদানই বেশি। এ সব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সফলতার কারণে আবদুর রাজ্জাক দলীয় হাইকমান্ডের ‘গুড বুকে’ আছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

তাছাড়া বিগত কয়েক মাসে ঢাকার বাইরে আওয়ামী লীগের তৃণমূল সম্মেলনে রাজ্জাককে পাঠানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের ভেতর আলোচনা আছে যে, ধীরে ধীরে কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বের জন্য আবদুর রাজ্জাককে তৈরি করছেন শেখ হাসিনা। নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা রাখার জন্যই স্বচ্ছ ভাবমূর্তির এই নেতাকে তুলে আনার চেষ্টা হচ্ছে। ২০০৯ সালের সম্মেলনের পর আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হোন আবদুর রাজ্জাক। এরপর ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সম্মেলনেও একই পদে পুনঃনির্বাচিত হন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা এই সময়কে বলেন, ‘ব্যক্তি হিসেবে আবদুর রাজ্জাক সজ্জন। দলে তার ভাবমূর্তিও ইতিবাচক। দলের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল এই নেতার সাংগঠনিক দক্ষতা নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই। তার মতো একজন সক্রিয় রাজনীতিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলে দলের জন্য খারাপ হবে না।’

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন এই সময়কে বলেন, ‘জাতীয় সম্মেলনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণার পর থেকেই ভেতরে ভেতরে দলের নেতা-কর্মীদের মানসিক প্রস্তুতি চলছে। তবে মূল প্রস্তুতি শুরু হবে মার্চে।’ তিনি বলেন, ‘দলের সাধারণ সম্পাদকের মতো দায়িত্বশীল পদে কোনো পরিবর্তন হবে কি না তা জানার জন্য ২৮ মার্চ পর্যন্তই অপেক্ষা করতে হবে। এ নিয়ে আগাম বলা যাবে না। কারণ দলের সভাপতি যাকে যোগ্য মনে করবেন তাকেই দায়িত্ব দেবেন।’

গঠনতন্ত্রে আসতে পারে পরিবর্তন

দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, এবারের সম্মেলনে দলের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন হতে পারে। গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সংখ্যা ৭৩ থাকলেও তা বাড়িয়ে এবার ৮১ করা হতে পারে। বর্তমান গঠনতন্ত্রে সভাপতিম-লীর সদস্য আছেন ১৫ জন। এটা বাড়িয়ে ১৭ বা ১৯ করা হতে পারে। বর্তমানে সম্পাদকম-লীর সদস্য আছেন ৩২ জন। এটা বাড়িয়ে ৩৯ করা হতে পারে। এর মধ্যে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ সাতটি থেকে বাড়িয়ে দশটি করা হতে পারে। নতুন সাংগঠনিক সম্পাদক হবেন ফরিদপুর, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা বিভাগীয়। আর সে ক্ষেত্রে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ তিনটি থেকে পাঁচটি করা হতে পারে। নতুন পদ হতে পারে তথ্য ও প্রযুক্তি, সমবায়, প্রকাশনা সম্পাদকের। আর কমবে সভাপতি মনোনীত সদস্যের সংখ্যা। বর্তমান গঠনতন্ত্রে কোষাধ্যক্ষসহ ২৬টি পদ থাকলেও বেশ কয়েকটি কমানো হতে পারে। এই পদ থাকতে পারে ২১টি। তবে সব কিছুই নির্ভর করছে সভাপতি শেখ হাসিনার সম্মতির ওপর।

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, গত ৯ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী বৈঠকে আগামী কেন্দ্রীয় কমিটির কাঠামো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ এই সময়কে বলেন, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সংখ্যা বাড়াতে হলে আমাদের কার্যনির্বাহী কমিটির অনুমোদন নিতে হয়। গত বৈঠকে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। সম্মেলনের আগে আরও কার্যনির্বাহী বৈঠক হবে, সেখানে হলে হতেও পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সম্পাদকম-লীর একাধিক সদস্য জানান, নতুন সাংগঠনিক জেলাগুলো হবে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, ফরিদপুর মহানগর ও ময়মনসিংহ মহানগর।

প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে

২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলন হয়। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বর্তমান কার্যনির্বাহী সংসদের মেয়াদ গত ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। ডিসেম্বরে সম্মেলন করার কথা থাকলেও পৌরসভা নির্বাচনের কারণে তা হয়নি। গত ৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে ২৮ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২০তম সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর আগে গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় ডিসেম্বরে জাতীয় সম্মেলনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পৌর নির্বাচনের কারণে তা পিছিয়ে যায়।

সূত্র জানায়, এ সম্মেলন সফল করতে ১০টি উপ-কমিটির খসড়া তৈরি করে সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে জমাও দিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এ সব উপ-কমিটির খসড়া তালিকা অনুযায়ী সম্মেলন প্রস্তুতি উপ-কমিটির আহ্বায়ক সভাপতিও থাকবেন শেখ হাসিনা। কেন্দ্রীয় কমিটির সব সদস্যই সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবেন। অভ্যর্থনা উপ-কমিটির আহ্বায়ক থাকছেন সভাপতিম-লীর সদস্য সাজেদা চৌধুরী, খাদ্য উপ-কমিটির দায়িত্বে দেওয়া হতে পারে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে, দপ্তর উপ-কমিটির আহ্বায়ক থাকছেন সভাপতিম-লীর সদস্য ওবায়দুল কাদের, সাজসজ্জা উপ-কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বে থাকছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, প্রচার-প্রকাশনা উপ-কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করবেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এইচ টি ইমাম, মঞ্চ ও শৃঙ্খলা উপ-কমিটির দায়িত্বে থাকতে পারেন সভাপতিম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম ও সদস্য আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ। স্বাস্থ্য উপ-কমিটির দায়িত্বে থাকবেন মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, গঠনতন্ত্র সংশোধনে কৃষিবিষয়ক সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক, ঘোষণাপত্র উপ-কমিটির দায়িত্বে থাকতে পারেন দপ্তর সম্পাদক আবদুল মান্নান।

পেছাতে পারে সম্মেলন

মার্চের শেষ সপ্তাহে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় জাতীয় সম্মেলন নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনগুলোর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ব্যাপক জনগোষ্ঠীর স¤পৃক্ততায় অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া পৌরসভা নির্বাচনের পর এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দলীয়ভাবে এবং দলীয় প্রতীকে। ব্যাপক পরিসরের এই নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন করা সম্ভব নাও হতে পারে বলে দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। যদিও কেউ কেউ বলছেন, ইউপি নির্বাচন হতে পারে এপ্রিলে। সেটা হলে নির্ধারিত সময়ে আওয়ামী লীগের সম্মেলন করা সমস্যা হবে না। তবে এ ব্যাপারে এখনও দলের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে ধারাবাহিকভাবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট নেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে বলেও জানান তিনি।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হলে সম্মেলন পিছিয়ে যেতে পারে। কারণ, সম্মেলনের প্রস্তুতির কাজ এখনও শুরু হয়নি। সম্মেলনের আগে দলের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রে সংশোধন, সংযোজন, বিভিন্ন উপ-কমিটি গঠন এবং কমিটিগুলোর কাজ শুরু করাসহ বেশ কিছু প্রস্তুতির বিষয় রয়েছে। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, ‘সম্মেলনের সিদ্ধান্ত হয়েছে ২৮ মার্চ। এর কোনো প্রস্তুতি এখনও আমরা শুরু করিনি।’ সম্মেলনের এখনও অনেক দেরি। ইউপি নির্বাচনের মধ্যে সম্মেলন সম্ভব কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে থেকে কিছু বলা যাচ্ছে না। সময় হলে সব সিদ্ধান্ত হবে।’

একনজরে সৈয়দ আশরাফ

সৈয়দ আশরাফ একজন মুক্তিযোদ্ধা। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় প্রচার স¤পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতার হত্যার পর সৈয়দ আশরাফ যুক্তরাজ্যে চলে যান এবং লন্ডনের হ্যামলেট টাওয়ারে বসবাস শুরু করেন। লন্ডনে বসবাসকালে তিনি বাংলা কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। সেখানে তিনি লন্ডন যুবলীগের সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ সালে সৈয়দ আশরাফ দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সরকারের শেষ সময়ে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির মধ্যেও কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সৈয়দ আশরাফ। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সৈয়দ আশরাফ। তবে ২০১৫ সালের শেষভাগে এসে তাকে এলজিআরডি মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়। ২০০২ সালের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফ দলের যুগ্ম সাধারণ স¤পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ১/১১-এর সময় তাকে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ স¤পাদক করা হয়।

একনজরে ওবায়দুল কাদের

ওবায়দুল কাদের কলেজজীবন থেকে রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলন ও ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানা মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) অধিনায়ক ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার কারাবরণ করেন। ১৯৭৫ সালের পর একনাগাড়ে দীর্ঘ আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন ওবায়দুল কাদের। কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং পরপর দুইবার ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখিতেও জড়িত এই রাজনীতিবিদ। দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। লিখেছেন আটটি বই। ’৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। পরে ওই সরকারের আমলে যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী হন।

২০০২ সালের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন থেকে ২০০৯ সালের সম্মেলন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রথম যুগ্ম সাধারণ স¤পাদক ছিলেন ওবায়দুল কাদের। ১/১১ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে তিনি ২০০৭ সালের ৯ মার্চ গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় দেড় বছর বন্দি থাকেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে নোয়াখালী-৫ আসন থেকে আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে তিনি দলের সভাপতিম-লীর সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর বঙ্গভবনে মহাজোট সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন ওবায়দুল কাদের। বর্তমানে তিনি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।

একনজরে আবদুর রাজ্জাক

১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ¯œাতক ও ১৯৭২ সালে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন আবদুর রাজ্জাক। ১৯৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পারডু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপরই বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ২০০১ সালে অবসরে যান তিনি। ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি রাজ্জাকের। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ও ’৬৯ সালে এগার দফা আন্দোলনে তার সক্রিয় অবস্থান ছিল। ’৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়ার কারণে তাকে কারাবরণ করতে হয়।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী (’৭২-৭৩) সেশনে তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদের জিএস নির্বাচিত হন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, সভাপতির দায়িত্ব পালন শেষে তখন তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্বাহী কমিটির সদস্যও নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধেও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল রাজ্জাকের। টাঙ্গাইলে মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন তিনি। ১৯৯৬-৯৭ সেশনে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের মহাসচিব নির্বাচিত হন রাজ্জাক। এক-এগারোর পর শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে তার মুক্তির দাবিতে জরুরি অবস্থা চলাকালেই বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে কর্মীদের আস্থায় আসেন আবদুর রাজ্জাক।

সৌজন্যে: এই সময়



মন্তব্য চালু নেই