‘আমি এখনও মানুষ হত্যার মেজাজে আছি’

‘আমি যদি পারতাম, তাহলে আবারও যুদ্ধে যোগ দিতাম এবং বর্তমানের তথাকথিত ইউক্রেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতাম।’ কথাগুলো দম্ভের সঙ্গে বলছিলেন সাবেক সার্বিয়ান পাদ্রী ও সেনা কমান্ডার ভোজিস্লাভ কারকিক। ৭৯ বছর বয়সী এই মানুষটিকে পপ জুকো নামেই তার সমসাময়িক মানুষ বেশি চেনে। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সার্বিয়ার সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ভয়ানক চেতনিক ডিভিশনের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। বসনিয়ার যুদ্ধে সেনাবাহিনীর হয়ে সারাজেভোর নিকটবর্তী গ্রাভিকা নামক স্থানে ছিল তার ব্যাটালিয়ন।

কারকিক যুদ্ধক্ষেত্রে শুধু একজন যোদ্ধাই ছিলেন না, পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন পাদ্রীও বটে। খিস্ট্রানদের মধ্যে অর্থোডক্স মতাবলম্বী কারকিক যুদ্ধের ময়দানে ধর্মান্তরিত করা থেকে মৃত সৈনিকদের সমাধিস্ত করার সময় ধর্মীয় নিয়মও পালন করতেন তিনি। স্মৃতি হাতরে হাতে ঐতিহ্যবাহী বলকান মদ নিয়ে বলতে থাকেন, ‘স্নাইপার রাইফেলের সামনেও আমাকে কবরস্থ করতে হয়েছে সৈনিকদের দেহ। কোনো কোনো দিন বিশটিরও বেশি কবর খুড়তে হয়েছে। তাই হয়তো কবরের সঙ্গে আমার এক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। দুর্ভিক্ষের সেই সময়ে মৃত্যুই ছিল শুধুমাত্র ঘটনা।’

তার চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এই মানুষটির চেহারার পেছনেই রয়েছে তার বর্বর অতীত। ১৯৯৫ সালের নভেম্বর মাসে শান্তি চুক্তি হবার আগ পর্যন্ত গ্রাভিকা ছিল সারজেভো থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। যুদ্ধের সময়ে ওই এলাকাটি নিয়ন্ত্রন করতো সার্বিয় বাহিনী। যুদ্ধ শেষে দেশটি মোটা দাগে দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। রিপাবলিক স্পাসকার অধিকাংশই জাতিতে সার্ব এবং ফেডারেশন অব বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনার অধিকাংশই বসনিয়ান এবং ক্রোয়েট। পরবর্তীতে গ্রাভিকা বসনিয়ার অর্ন্তভূক্ত হলে কারকিকসহ অধিকাংশ সার্বই পালিয়ে চলে যান।

সেনাবাহিনীর মাঝে একজন পাদ্রী হওয়া স্বত্ত্বেও কারকিক ছিলেন যুদ্ধে ব্যবহার্য অস্ত্রের দায়িত্বে। সেই অস্ত্র নিয়ে প্রায়শই সারজেভোর সাধারণ মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি চালাতে পিছপা হননি তিনি। ‘বালিয়াদের থেকে আমার মানুষদের রক্ষা করার জন্য আমি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম।’ প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুসারে যুদ্ধের পর কারকিক ভ্লাকায় ফিরে যান এবং সেখানে পরিবারের সঙ্গে বাস করতে থাকেন। সার্বিয় অপর যুদ্ধপরাধী রডোভিচ ম্লাদিচকে দ্য হেগের আদালত থেকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করানো হয়েছে। কারকিককে তার যুদ্ধবর্তী কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন করলে তার মধ্যে কোনো অনুতাপ দেখা যায় না। তাইতো শোনা যায়, ‘যুদ্ধেই হোক আর উর্দি পরিহিত অবস্থাতেই হোক আমি সবসময়ই খ্রিস্টের সৈনিক। সার্বিয়ান জনগণের যোদ্ধা এবং একজন নিখাদ চেতনিক আমি।’

চেতনিকরা হলো একটি গোড়া রক্ষনশীল। তারা অটোম্যান সাম্রাজ্যের সেই সময় সার্বিয়ান ন্যাশনালিস্ট প্যারামিলিটারি এবং রাজনৈতিক দল খোলে। তাদের স্বপ্ন ছিল, সাবেক বৃহত সার্বিয়ান সাম্রাজ্য কায়েম করা। এবিষয়ে ঐতিহাসিক ইভো ব্যানাক বলেন, ‘তাদের অন্যতম লক্ষ্যই ছিল রাজতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত সার্বিয় শাসন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় তারা ইতালি এবং জার্মানদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট শাসনামলে চেতনিক নামটিই ধরতে গেলে নিষিদ্ধ ছিল এবং তাদের প্রতি কেউ সহানুভূতি দেখালেও তাকে বিচারের মুখোমুখি দাড়াতে হতো।’

১৯৯০ সালের দিকে সার্বিয়ার আল্ট্রা জাতীয়তাবাদী দলের নেতারা চেতনিককে যুদ্ধের আদর্শ অস্ত্র হিসেবে পেলেন। গঠিত হলো ভোজিস্লাভ সেসিলের সার্বিয়ান র‌্যাডিক্যাল পার্টি, যারা প্যারামিলিটারি বাহিনীর সহকারী হিসেবে কাজ করতো। এই দলটি সার্বিয়ার বিভিন্ন স্থানে অ-সার্বদের উপর অত্যাচার করার ব্যাপারে ক্রমশ দক্ষ হয়ে উঠছিল। দলের সমস্যরা সবাই নিজেদের সার্বিয়ান অর্থোডক্স চার্চের অনুসারী হিসেবে অসার্বদের হত্যা করা নিজেদের পবিত্র দায়িত্ব বলেই মনে করতো। আজও তারা অখন্ড সার্বিয়ার রাজ্যের স্বপ্ন দেখে। যেমনটা শোনা যায় কারকিকের কণ্ঠে, ‘চেতনিকরা আগে যেমন ছিল এখনও তেমনিই আছে। আমরা রাজতন্ত্রের প্রতি বিশ্বস্ত এবং আমাদের রাজাকে ফিরিয়ে আনতে চাই।’

অপর এক ঐতিহাসিক সাবরিনা পেত্রা র‌্যামেতের মতে, ‘চেতনিকরা গ্রামকে গ্রাম উজার করে দিয়েছিল। মুসলিম এবং ক্রোয়েটদের জবাই করে হত্যা করেছে তারা। চেতনিকরা শুধু অসার্বদের মধ্যেই সন্ত্রাস ছড়ায়নি, তারা নিজেদের মধ্যেও যারা চেতনিক মতাদর্শকে মানতে পারতো না তাদের হত্যা করতো।’ চেতনিকদের নিয়ন্ত্রিত একটি বন্দী শিবির ছিল ত্রেনোপলজি। এই শিবিরেই বন্দী হিসেবে ছিলেন ইসমুদা মুজাগিক নামের এক মুসলিম নারী। সৌভাগ্যক্রমে তিনি সেই বন্দীশালা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তার জবানিতে জানা যায়, ‘১৯৯২ সালের জুলাই মাসে আমার পুরো পরিবারসহ সরিয়ে নেয়া হয়। জোরপূর্বক আমাদের নিজেদের বাড়ি ঘর থেকে উৎখাত করে একটি কনভয়ে করে নিয়ে যাওয়া হয়। চেতনিক আর সার্বরা তখন আমাদের পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়।’

সার্বিয়ার গণহত্যার বিচার আজও আন্তর্জাতিক যুদ্ধপরাধ আদালতে হচ্ছে। কারদোভিচ থেকে শুরু করে অনেককেই বিচারের মুখোমুখি দাড় করানো হচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও কারকিকের মধ্যে নেই কোনো অনুশোচনা বা আত্মবিলাপ। উল্টো তাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি এখন অবসরে আছি। কিন্তু আমি এখনও মানুষ হত্যার জন্য ভালো মেজাজে আছি। আমার কোনো অনুশোচনা নেই। সবকিছুই ঈশ্বরের হাতে নিয়ন্ত্রিত। আমি যাই করেছি, তা আবারও করতে আমি প্রস্তুত। কিন্তু আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন আমার আত্মা আছে কিনা, তখন আমাকে বলতে হবে যে, আমার কোনো আত্মা নেই।’



মন্তব্য চালু নেই