“আমার স্বামী নগ্ন মেয়ে মানুষ দেখে কী মজা পায় বলতে পারো?”

শুরুতেই বলে নিচ্ছি যে আজ আমি সম্পূর্ণ নারীবাদী একটি লেখা লিখবো। অন্তত আপনাদের ভাষায় সেটা তাই- “নারীবাদী”। মূলত আজ আমার এই দীর্ঘ লেখা “প্রিয় সম্পর্ক” বিভাগে আসা এমন একটি সমস্যা নিয়ে, যেটা অশ্লীলতার অভিযোগে দুষ্ট হবে বিধায় প্রকাশ করা হয়নি। সমস্যাটি বুঝতে অশ্লীল অংশটি জরুরী, ফলে অনেকেই সেটা পড়ে চটি গল্প পড়ার আনন্দ পেতে পারেন। কিন্তু সমস্যাটি এতই ভয়াবহ যে আমি মনে করি ব্যাপারটা সকলের জানা উচিত। মার্জিত ভাষায় কাহিনীটি তুলে ধরার জন্যই লিখছি আজ… এবং সাথে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এমন অশালীন একটি শিরোনাম দেবার জন্য। কেন দিয়েছি এই শিরোনাম, সেটা পুরো লেখাটি পড়লেই বুঝতে পারবেন।

প্রিয় সম্পর্ক বিভাগে যত প্রশ্ন পাই, তাঁর একটা বড় অংশ থাকে স্বামীর পর্ণ আসক্তি বিষয়ক। অসংখ্য নারী ক্রমাগত এই অভিযোগ করছেন যে তাঁদের স্বামী পর্ণ আসক্ত। পর্ণগ্রাফিতে পর্ণ তারকাদের যৌন কর্ম দেখে তাঁরা এতটাই বিভোর হয়ে থাকেন যে বাস্তব পৃথিবীর সঙ্গিনীর দিকে তাকাবার সময় নেই। নিখুঁত কৃত্রিম শরীরের সুন্দরী পর্ণ নায়িকাদের দেখে স্বামীর কাছে স্ত্রীকে তখন পানসে আর অসুন্দর মনে হয়। কেউ কেউ স্ত্রীকে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকেন পর্ণ তারকার শরীর বানানোর জন্য কিংবা বিছানায় পর্ণ তারকার মত আচরণ করার জন্য। একটিবার তাঁদের মাথায় এটা আসে না যে পর্ণ তারকাদের এটা পেশা আর তাঁর স্ত্রী একজন রক্ত মাংসের মানুষ। স্ত্রী তাঁর জীবন সঙ্গিনী, তাঁর সন্তানদের মা। স্ত্রী ভালোবাসা পাবার অধিকার রাখেন, সম্মান পাবার অধিকার রাখেন এবং তাঁরও কিছু যৌন ইচ্ছা ও যৌন চাহিদা আছে।

কতটা নিচে নামলে নিজের স্ত্রীকে কেউ পর্ণ তারকার সাথে তুলনা করতে পারে? নিজের স্ত্রী ক্যামেরার সামনে নগ্ন হয়ে একের পর এক পুরুষের সাথে যৌন কর্ম করেছে, এমনটা ভেবেছেন কখনো? অন্য এক পুরুষ আপনার স্ত্রীর নগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে মজা পাচ্ছে, যৌন কর্ম করতে চাইছে, এটা কি ভেবেছেন কখনো? না ভাবলে একটু ভাবুন। আপনার কি ভাবতে ভালো লাগছে? লাগছে না! ঠিক একই ভাবে আপনি যখন আপনি অন্য মেয়ের নগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে যৌন কর্ম করার কথা ভাবেন, আপনার স্ত্রীরও কিন্তু ভালো লাগে না পুরুষ!

একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রতারণা কিন্তু কেবল শারীরিক হয় না, প্রতারণা সবার আগে হয় মানসিক। প্রিয় পুরুষটি অন্য নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়ালে নারী যেমন প্রতারিত অনুভব করে, প্রিয় পুরুষটি মনে মনে কোন নারীর প্রতি আগ্রহী হলে বা তাঁর শরীরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করলেও নারী একই রকম প্রতারিত অনুভব করে। আর সবচাইতে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয় তাঁর বিশ্বাস ও আস্থার জায়গাটি। স্বামী তাঁকে আসলেই ভালোবাসেন, এই বিশ্বাসটি নারী আর তখন ধরে রাখতে পারেন না। এবং ঠিক এই ব্যাপারটি ঘটে পর্ণের ক্ষেত্রেও। পর্ণগ্রাফি হচ্ছে নারী অবমাননার একটা চূড়ান্ত রূপ, এবং ন্যূনতম আত্মসম্মান বোধ আছে এমন কোন নারীই পর্ণ গ্রাফি পছন্দ করবেন না (যাদের আত্মসম্মান নেই, তাঁদের কথা ভিন্ন)। এবং প্রিয় পুরুষটি যখন পর্ণ গ্রাফিতে আসক্ত হন, নারীর কাছে সেটা চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রতারণা। পুরুষ হয়তো ভাবেন যে, “আমি তো কেবল দেখছি!” নারীর কাছে বিষয়টি এমন যে পুরুষ আরেক নারীর নগ্ন শরীর দেখছেন, তাঁকে কামনা করছেন এবং এই কারণে স্ত্রীকে তাঁর আকর্ষণীয় লাগছে না। সব মিলিয়ে বিষয়টি খুবই জটিল হয়ে যায়।

আমি হয়তো কিছুই বোঝাতে পারলাম না। অবশ্য কথা দিয়ে ঘৃণিত ও জঘন্য এই বিষয় সম্পর্কে কিছুই হয়তো বোঝানো যায় না। “আমি তো প্রতারণা করছি না, কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক করছি না, কেবল দেখছি!” – পুরুষের এই ভাবনা যে কখনো কি মারাত্মক রূপ নিয়ে নিতে পারে জীবনে, তার ছোট্ট একটা উদাহরণ দেব খালি আজ।

মেয়েটিকে আমি ফেসবুকে চিনি অনেক দিন, আমার সমবয়সী, পেশায় চিকিৎসক। স্বামীও একটা ভালো মাল্টি ন্যাশনালে জব করে, একটি ৪ বছরের ছেলে সন্তান আছে। বাড়িতে শাশুড়িও আছেন আর আছে একটি কাজের মেয়ে। একেবারে ছিমছাম, সুখী একটা পরিবার। অন্তত দূর থেকে দেখলে সেটাই মনে হবে যে কারো। মেয়েটি প্রায়ই অভিযোগ করতো যে স্বামী পর্ণ আসক্ত, তাঁকে খুব একটা সময় দেয় না। বিশেষ করে ছেলেটি হবার সময় পর্ণ আসক্তি স্বামীর অনেক বেড়েছে। ছেলে হবার পর থেকেই দুজনের মাঝে অনেকটা দূরত্ব। মেয়েটি শারীরিক মানসিক কোন দিক দিয়েই স্বামীর ভালোবাসা আর অনুভব করে না। কিছুদিন আগের কথা, মেয়েটি বিশাল একটি চিঠি পাঠালো আমাকে, যার শুরুটি ছিল এই রকম-” আমার স্বামী নগ্ন মেয়ে মানুষ দেখে কী মজা পায় বলতে পারো?”

চিঠিটি বিস্তারিত বলতে গেলে চটি লেখক হিসাবে গাল দেবেন আপনারা আমাকেই, তাই খুবই সংক্ষেপে বলছি। চিঠির সারমর্ম এই রকম যে মেয়েটি অনেক দিন ধরেই স্বামীর সঙ্গ থেকে বঞ্চিত। ব্যাপারটা যে পর্ণ আসক্তির কারণে, এটা সে ভালোই বোঝে। যাই হোক, একদিন সে গভীর রাতে স্বামীকে হাতে নাতে ধরে, হস্ত মৈথুনে রত অবস্থায়। না, কাহিনী এখানে শেষ নয়, সবে মাত্র শুরু। স্বামী যেগুলো দেখে হস্ত মৈথুন করছিলেন, সেটা রিয়েল লাইফ পর্ণ! স্টিল পিকচার, বাস্তবের একটি মেয়ের। এবং সেই মেয়েটি হচ্ছে বাড়ির সেই কাজের মেয়ে, যাকে কিনা শাশুড়ি রেখেছেন গৃহকর্মের জন্য! বিভিন্ন ভঙ্গিমায় মেয়েটি নগ্ন নানা রকম ছবি, বলাই বাহুল্য যে ফটোগ্রাফার মেয়েটির স্বামী নিজেই!

যা হবার তাই হলো। চিৎকার চেঁচামেচি ভাঙচুর। খুঁজে পেতে দেখা গেলো যে স্বামীর পিসিতে এমন অসংখ্য ছবি আছে। পর্ণ তো বটেই, বাস্তবের মেয়েদের ছবিও। ফেসবুক আইডি ঘেঁটে দেখা গেলো সেখানেও একই অবস্থা। অসংখ্য আজেবাজে মেয়েদের সাথে খাতির এবং তাঁদের কাছ থেকেও আপত্তিকর ছবি ইনবক্সে এসেছে। মেয়েটি দ্বিধা করেনি, তখনই শাশুড়িকে সব জানিয়েছে। দুজনে মিলে বর ও কাজের মেয়েকে চেপে ধরার পর জানা গেলো যে তাঁদের মাঝে কোন শারীরিক সম্পর্ক নেই। বর কাজের মেয়েকে মোটা অংকের টাকা দিয়েছে এইসব ছবি তোলার জন্য। কেবলই ছবি, আর কিছু না। মেয়েটি যখন হসপিটালে নাইট ডিউটি করে, মায়ের ঘুমের সুযোগে ছেলে তখন এসব করে। এবং এত সবকিছুর পরও স্বামীর ভাষ্য হচ্ছে, সে তো কোন অন্যায় করেনি। সে কেবল ছবি দেখছিল, যেমন ভাবে বাজারের পর্ণ তারকাদের ছবি দেখে। এতে অন্যায় কী আছে?

এতে অন্যায় কী আছে, সেটা হয়তো রুচিহীন পুরুষেরা বুঝবেন না। মেয়েটি স্বামী তেমনই রুচিহীন একজন। কিন্তু না, কাহিনী এখানে শেষ না। মেয়েটি স্বামীর কথা বলতে আমাকে নক করেছে ঠিকই, কিন্তু আসলে মূল সমস্যা তার নিজের। স্বামীর এমন আচরণ ক্রমাগত দেখতে দেখতে মেয়েটির মাথায় কোনভাবে ঢুকে গিয়েছে যে সে যথেষ্ট আকর্ষণীয় না। সে যদি পর্ণ তারকাদের মত বা স্বামীর সংগ্রহের মেয়েদের ছবিগুলোর মত করে ছবি তুলতে পারে, তাহলে স্বামীও তার প্রতি আগ্রহী হবে। এই ভাবনা থেকে বিগত কিছু মাস যাবত সে পাগলের মত ছবি তুলে যাচ্ছে নিজের। সবই পর্ণ তারকাদের ভঙ্গিতে তোলা নগ্ন ছবি, স্বামীর কালেকশনের মত। মেয়েটি তার নিজের ছবিও আমাকে দেখিয়েছে, স্বামীর সংগ্রহের ছবিও, পুরো ব্যাপারটি ভালো করে বোঝাতে।। আমি অসম্ভব ব্যথা নিয়ে লক্ষ্য করেছি যে সেই কাজের মেয়ের প্রতিটি ভঙ্গি এই মেয়েটি অনুকরণ করে করে পোজ দিয়েছে। একজন উচ্চ শিক্ষিত মানুষের মানসিক ভারসাম্য কীভাবে এলোমেলো হলে এটা সম্ভব কেউ কি আন্দাজ করতে পারছেন? বুঝতে পারছেন মেয়েটি কি ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছিল?

এখন মেয়েটি নিজেও বুঝতে পারছে যে সে তীব্র একটা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে। স্বামীর প্রতি তীব্র ভালোবাসা ও প্রতারিত হবার তীব্র কষ্ট মেয়েটির মনোজগত একেবারেই এলোমেলো করে দিয়েছে। এখন সে ব্যাপারটি থেকে বের হতে চায়, নিজেকে শুধরে নিতে চায়। এ উদ্দেশ্যে নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্যসেবাও নিচ্ছে সে। কিন্ত ততদিনে ভুল যা হবার হয়ে গিয়েছে। স্বামী যেরকম ফেসবুকে মেয়েদের কাছ থেকে নোংরা ছবি নেয়, মেয়েটিও ফেসবুকে এক ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করে নিজের নোংরা ছবি দিয়েছে। একটা মিছেমিছি প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছে। এখন যখন এই মিথ্যা সম্পর্ক সে ভেঙে ফেলতে চাইছে, ছেলেটি বলাই বাহুল্য যে হুমকি দিচ্ছে সব ছবি ইন্টারনেটে ফাঁস করে দেয়ার। মেয়েটি স্বামীকে সব জানিয়েছে, লুকায় নি। তাঁদের সংসারে এই মুহূর্তে কী হচ্ছে আমি জানিনা। কিন্ত স্বামী লোকটিকে আমি যখন ফোনে জিজ্ঞেস করলাম- “নিজের স্ত্রীর নগ্ন দেহের দিকে আরেক পুরুষ লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, এটা ভেবে কি এখন আপনার খুব ভালো লাগছে? খুব আনন্দ পাচ্ছেন?” … ফোনের ওপাশে তিনি নীরব। অন্য নারীর নগ্ন দেহে নিজে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ধর্ষণ করলে যতটা ভালো লাগে, নিজের স্ত্রীর দেহের দিকে কেউ এক ঝলক দেখলেও আসলে তার চাইতে অনেক খারাপ লাগে। স্ত্রীকে লুকিয়ে পর্ণ দেখার সময় কোন পুরুষই সম্ভবত এটা চিন্তা করেন না!

পরিশিষ্ট
শুরুতেই বলেছি যে এই লেখাটি আমি মেয়েদের জন্য লিখেছি। কেবল একটি কাহিনী জানাবার উদ্দেশ্যে লিখেছি। তাই পুরুষেরা আমাকে গাল বকতেই পারেন। কিন্তু এটাও আমি নিশ্চিত জানি যে এমন কিছু হৃদয়বান পুরুষ আমাদের মাঝে আছেন, যারা এই কথাগুলো অনুধাবন করতে পারবেন। যারা মেয়েদের মন বোঝেন, কেবল শরীর বোঝেন না। যাদের কাছে বিয়ে মানে একজন নারীকে পাশে পাওয়া, আজীবনের জন্য সুখ দুঃখে পাশে থেকে ভালোবেসে যাওয়া। এই লেখাটি তাঁদের জন্যও।

আমি কেবল ছোট্ট একটি কথাই বলতে চাই সবশেষে, দাম্পত্য অসম্ভব সুন্দর একটা সম্পর্ক। আজীবনের সম্পর্ক। পর্ণ গ্রাফির মত কুৎসিত জিনিসকে ভালবাসতে গিয়ে এই সুন্দর সম্পর্কটিকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবেন না। এক কালে যে মানুষ পাগলের মত আপনাকে ভালোবাসতো, সেই মানুষের ঘৃণার পাত্র হয়ে যাবেন না যেন। আর ভালোবাসায় প্রতারিত হয়ে এমন কোন কিছু করে ফেলবেন না, যাতে কিনা আজীবন আপনাকেই পস্তাতে হয়। প্রিয় মানুষটি প্রতারণা করলে আর যাই করুন, নিজের কোন ক্ষতি করবেন না। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিজেকে বিপদে ফেলবেন না। প্লিজ! আমি কোন বিশাল জ্ঞানী-গুনী মানুষ নই। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে অপর সাধারন মানুষকে এটা আমার একান্ত অনুরোধ।

রুমানা বৈশাখী
গল্পকার ও রন্ধনশিল্পী

৮ ডিসেম্বর, ২০১৫



মন্তব্য চালু নেই