‘আমাকে শেষ করে দিয়েছে, স্যার’

‘আমি শেষ হয়ে গেছি। আমাকে বাঁচান। আমার পাশে কেউ নেই। চিকিৎসা করানোরও টাকা নেই।’

এভাবেই আকুতি জানাচ্ছিলেন মো. সাজু। তিনি রোববার রাতে পোড়া বস্তিতে পুলিশের গুলিতে আহত হন। বর্তমানে মিরপুর ১০ নম্বরের গ্যালাক্সি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি। সাজুর গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলায়।

এদিকে, বস্তিতে রিকশাচালককে গুলি করার ঘটনায় অভিযুক্ত দুই কনস্টেবলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করেছে পুলিশ।

সাজু বলেন, ‘রোববার গভীর রাতে মিরপুর থানার এসআই পলাশ তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে ১০ নম্বরের গ্যালাক্সি হাসপাতালে ভর্তি করে রেখে যান। কারো সঙ্গে কথা বলতেও বারণ করেন। সেই থেকে আর কেউ তার খোঁজ নেয়নি। সোমবার সকালে পায়ের আঙুলের কিছু অংশ অপারেশন করে ফেলে দেওয়া হয়। এখন অপারেশনের পর টাকা দিতে না পারায় কর্তৃপক্ষ হাসপাতাল থেকে বের করে দিতে চাচ্ছে। অথচ আমার যে অবস্থা, তাতে হাঁটা তো দূরের কথা, নড়াচড়া করাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে ওই রিকশাচালক আরো বলেন, ‘ডাক্তাররা বলেছে, প্রায় লক্ষাধিক টাকা লাগবে। আমি একজন রিকশাচালক। দিন আনি দিন খাই। এত টাকা কোথায় পাব? আমি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সংসারে দুই মেয়ে। এখন রিকশা চালাতে না পারলে চিকিৎসা করানো তো দূরের কথা, পরিবারের ভরণপোষণ পর্যন্ত করা যাবে না। তারপর কতদিন এভাবে থাকতে হবে তারও কোনো হিসাব নেই। আবার বস্তির ঘরও ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখন আমি কী করব? আপনারা একটু আমার পাশে দাঁড়ান।’

গ্যালাক্সি হাসপাতালের ৭ম তলায় চিকিৎসাধীন সাজু সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, ‘সারাদিন রিকশা চালিয়ে বিকেল ৫টার দিকে বস্তিতে আসি। শীত থাকায় কয়েকজন আগুন পোহাচ্ছিলাম। এ সময় ওই দুই পুলিশ আসে। তারা এসেই চাঁদা দাবি করে। মোবাইল কেড়ে নেয়। প্রথমে চড়-থাপ্পর মারে। এরপর রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করতে থাকে। আমার ঠোঁট ফেটে যায়। তারা দুজন আমাকে ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসে নিয়ে যায়। তখনই মনে হয়েছিল, জীবন শেষ। এখানে আনার পর প্রথমে মারধর করে। পরে পায়ে গুলি করে। মেরে ফেলারও হুমকি দেয়। যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন এ স্মৃতি ভোলার নয়। সুস্থ হলেই পরবর্তী চিন্তা করব।’

অন্যদিকে থানার একটি সূত্র বলছে, সাজুকে মূলত ওসির নির্দেশে রাতে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ঘটনা যেন আর বেশি দূর গড়াতে না পারে, সেজন্য গোপনে তাকে ভর্তি করা হয়। কোনো সাংবাদিক যেন না আসতে পারে, সাজুর সঙ্গে কথা বলতে না পারে, সেজন্য এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর এসব করা হচ্ছে ওসির নিজেকে রক্ষা করতে। কেননা ওই দুই পুলিশ সদস্য যদি দায়ী হয়, তাহলে তিনিও এর বাইরে নন। কেননা, তারা ওসির অধীনে ছিলেন। তার বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।

এদিকে সন্ধ্যায় মিরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ভূঁইয়া মাহবুব হাসান জানান, পুলিশের কনস্টেবল রিজভি ও হারুনকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। মামলা চলাকালে তদন্ত হবে। তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হলে, তাদের স্থায়ীভাবে চাকরি হারাতে হবে। এক্ষেত্রে নিজেকে বাঁচানোর প্রশ্নই ওঠে না।

পুলিশের প্রাক্তন আইজি এ এস এম শাহজাহান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘পুলিশের এ ধরনের আচরণ পুরো বাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই যে পুলিশ সদস্য দায়ী, তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। জনগণের রক্ষক দ্বারা এ ধরনের হামলা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, ‘পুলিশ যা করছে, তা সব রেকর্ডকে হার মানিয়েছে। জনগণের নিরাপত্তা না দিয়ে তাদের দ্বারাই মানুষ হামলা শিকার হচ্ছে। পুলিশের এত ক্ষমতা কোথা থেকে পেল, তা খুঁজে বের করতে হবে। একই সঙ্গে তদন্তের মাধ্যমে এ ধরনের আচরণকারী পুলিশ সদস্যকে বাহিনী থেকে বের করে দেওয়ারও কোনো বিকল্প নেই। আনতে হবে বিচারের আওতায়।’

জানা গেছে, রোববার রাতে সাজুসহ চার-পাঁচ জন যুবক বস্তির আট নম্বর অংশের একটি গলিতে বসে গল্প করছিলেন। এ সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য এসে তাদের ধরে নিয়ে বস্তির চার নম্বর অংশে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের কার্যালয়ে নিয়ে যায়। তাদের বুট দিয়ে লাথি মারে, রাইফেলের বাট দিয়ে সাজুকে আঘাত করে। রাইজিংবিডি



মন্তব্য চালু নেই