আবারো মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার চাইল অ্যামনেস্টি

আবারো ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার দাবি করলো লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বুধবার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি এই দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।

দেশের জন্য আত্মত্যাগকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কটাক্ষ করে অ্যামনেস্টির বিতর্কিত মন্তব্যের পর গত নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ ওই সংস্থাটিকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। এরপর বুধবার সংস্থাটি বাংলাদেশ সরকারের ওই আহ্বানের জবাবে আরেকটি বিতর্কিত বিবৃতিতে ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধ প্রসঙ্গে বলেছে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জোরালোভাবে বিশ্বাস করে, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশেও সংঘাতের সময় উভয় পক্ষেরই চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় অপরাধ সংঘটনের জোরালো প্রমাণ রয়েছে। আমরা উভয় পক্ষকেই বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানাই।

অ্যামনেস্টি বলেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক আইনে সন্দেহভাজন অপরাধ সংঘটনকারী যেই হোক না কেন, তার স্বাধীন ও কার্যকর বিচারের জন্য তারা আহ্বান জানাচ্ছে।

এর আগে ২৭ অক্টোবর অ্যামনেস্টি এক বিবৃতিতে যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড, তাদের বিচার ও আপিল প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সেখানে অ্যামনেস্টি বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার দাবি করে। বাংলাদেশে এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিগুলো এর কঠোর সমালোচনা করেন। সরকার কড়া ভাষায় এ বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়।

অ্যামনেস্টি তার গত বুধবারের বিবৃতিতে বলেছে, গত ৬ নভেম্বর লন্ডনে বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনার খন্দকার মো. তালহার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ তারা পেয়েছে। এর দীর্ঘ দুই মাস ২২ দিন পর গত বুধবার তার জবাব দেয় তারা। এতে অ্যামনেস্টির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিযোগকে ‘মিথ্যা’ অভিহিত করে বলা হয়েছে, তারা এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছে। এর সারসংক্ষেপ বিবৃতি আকারে অ্যামনেস্টি তুলে ধরেছে।

বাংলাদেশ অভিযোগ করেছিল, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিতর্কিত মন্তব্যের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের দেশবিরোধী প্রপাগান্ডার সাদৃশ্য আছে। ঢাকা মনে করে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের মুখোমুখি ব্যক্তিদের ‘বিরোধী নেতা’ হিসেবে তুলে ধরে সংস্থাটি এ বিচারপ্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক রং দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিচ্ছে।

জবাবে অ্যামনেস্টি নিজেকে ‘স্বাধীন’ ও ‘নিরপেক্ষ’ সংস্থা হিসেবে দাবি করে বলেছে, তারা বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ন্যায়বিচারের পক্ষে কাজ করে। বাংলাদেশের কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষে তারা কাজ করে না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার— সবার আমলেই তারা মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করেছে।

যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ‘বিরোধী নেতা’ উল্লেখের কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলেছে, ওই ব্যক্তিদের রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে জনসাধারণের ধারণার ওপর ভিত্তি করেই তারা এটি বলেছে।

অ্যামনেস্টিকে পাঠানো বার্তায় বাংলাদেশ দাবি করেছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনকারীরা এ বিচার ঠেকাতে দেশে যেমন সন্ত্রাস ও সহিংসতা চালাচ্ছে, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নানা ধরনের তৎপরতায় লিপ্ত। ওই গোষ্ঠীর সঙ্গে অ্যামনেস্টির জড়ানোকে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার দুঃখজনক বলে মনে করে। যুদ্ধাপরাধের বিচারকে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট উল্লেখ করে অ্যামনেস্টি তার নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের অবস্থান থেকে সরে এসে আসামি ও তাদের দেশি-বিদেশি দোসরদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছে।

অ্যামনেস্টির গত বুধবারের বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, তারা ১৯৭১ সালে সংঘটিত বড় পরিসরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার দাবি করে আসছে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনকেও অ্যামনেস্টি স্বাগত জানিয়েছে। তবে ন্যায়বিচার নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছে এবং অপরাধ যাই হোক না কেন মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিরোধিতা করেছে।

সংস্থাটি আরো দাবি করেছে, তারা তাদের গবেষণায় দেখতে পেয়েছে, বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মুখোমুখি ব্যক্তিরা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ২০১০ ও ২০১৩ সালে অ্যামনেস্টি বাংলাদেশ সরকারের কাছে এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। তাদের দাবি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টের মতো বড় মানবাধিকার সংস্থাসহ বিভিন্ন দেশের সরকারের এ বিচার নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।

বাংলাদেশ জোর দাবি করে আসছে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিশ্বের একমাত্র যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল যেখানে সাজা পাওয়া ব্যক্তিদের আপিলের সুযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজা পাওয়া ব্যক্তিরা এ দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করতে পারেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডাদেশ আপিল আদালতে গিয়ে বাতিল হওয়ার নজিরও আছে।

বাংলাদেশ মনে করে, মামলা ও অভিযোগ বিবেচনা না করে স্বাধীন একটি আদালতের স্বচ্ছ বিচারিক মান নিয়ে অ্যামনেস্টি ঢালাওভাবে মন্তব্য করে আসছে, যা সংস্থাটির দায়িত্বজ্ঞানহীনতার বহিঃপ্রকাশ। অ্যামনেস্টির মৃত্যুদণ্ডবিরোধী অবস্থান থাকলেও সংস্থাটি কেবল নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে উদ্বেগ জানায়। তাই অ্যামনেস্টিকে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক হিসেবে বিবেচনা করার কোনো যুক্তি নেই।

অ্যামনেস্টি গত বুধবার এ প্রসঙ্গে বলেছে, অপরাধ যত গুরুতর হোক না কেন, তাদের অবস্থান মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। তার অর্থ এই নয় যে তারা বিচার চায় না। বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড ব্যবস্থা বিলোপ করতে অ্যামনেস্টি প্রচারণা চালিয়ে যাবে।

অ্যামনেস্টি তার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে বলেছে, তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করতে চায়। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসার সুযোগ দিতে সংস্থাটি তাদের সদস্যদের জন্য ভিসা চেয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই