আন্দোলনে যাচ্ছেন ৪ লাখ সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক

দীর্ঘদিন ধরে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তাই দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদাসহ বেতন স্কেল প্রধান শিক্ষকদের চেয়ে এক ধাপ নিচে নির্ধারণের দাবি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে তিন লাখ সহকারী শিক্ষকের। আর প্রায় দেড় বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা বাস্তবায়নের দাবি প্রায় ৫০ হাজার প্রধান শিক্ষকের।

পদমর্যাদা বাস্তবায়ন আর আর্থিক বৈষম্য দূরীকরণ-প্রধান এই দুটিসহ প্রায় ১২টি দাবি নিয়ে দেশের প্রায় ৬৩ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক গত দেড় বছর ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছেন।
বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে শিক্ষকরা আজ মানববন্ধন তো কাল বিভাগীয় সমাবেশ-অবস্থান ধর্মঘট করছেন। মাঝে টানা চার দিন এক ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করেছেন এই শিক্ষকদের একটি অংশ। প্রায়ই প্রধানমন্ত্রী বরাবর জেলা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে স্মারকলিপি পেশ করছেন তারা।

গত বৃহস্পতিবারও বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজ ও বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক ঐক্যজোট নামে দুটি সংগঠনের ব্যানারে পৃথকভাবে দেশের ৬৪টি জেলার প্রশাসকের কাছে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেন শিক্ষকরা। কখনও আবার কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুমকি দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করছেন। কিন্তু তাদের এসব দাবির বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া দেওয়া হচ্ছে না। বরং প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা গেজেটেড করা হবে কি না তা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্তহীনতায় আছে সরকার।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, গত ১২ আগস্ট আপাতত নন-গেজেটেড দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, প্রধান শিক্ষকদের নতুন স্কেলে বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। পরে আবার গত ১৭ আগস্ট প্রধান শিক্ষকদের গেজেটেড করার বিষয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে আরেকটি চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু প্রধান শিক্ষকদের গেজেটেড করা হবে কি না-সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। এখন দাবি আদায়ে তারা আগামী সেপ্টেম্বর মাসে আরও কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. জ্ঞানেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, প্রধান শিক্ষকরা আগের মতোই নন-গেজেটেড কর্মকর্তা হিসেবে বেতন-ভাতা পাবেন। তবে আমরা তাদের গেজেটেড করার জন্য চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে একটি চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

সহকারী শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, তারা দাবি জানাতেই পারেন। কিন্তু তাদের বিষয়ে এখনও আমরা চিন্তা করছি না। এমনিতেই প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি সরকারের জন্য বুমেরাং হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারাও একই দাবি করতে পারেন। কিন্তু সরকারের পক্ষে একসঙ্গে সবার দাবি মানা সম্ভব নয়। তবে সহকারী শিক্ষকদের অনেক দাবি যৌক্তিক। আমরা সব শিক্ষকদেরই মূল্যায়ন করব। কিন্তু সেটা সময়ের ব্যাপার।

গত বছর ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার পদমর্যাদা ও বেতন স্কেল উন্নীত করার ঘোষণা দেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. জাহিদুর রহমান বিশ্বাস বলেন, মূল চারটিসহ ১২ দফা দাবি জানিয়ে সর্বশেষ গত ৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেছি। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত সাড়া দেয়নি। চলতি মাস জাতির জন্য শোকের। তাই এ মাসে কোনো কর্মসূচি আমরা দিচ্ছি না। কিন্তু আগামী মাসের ১০ তারিখের পর দাবি আদায়ে আমরা সহকারী শিক্ষকরা লাগাতার কর্মবিরতি পালন করব। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা করব। এই কর্মসূচিতে যেখানে বাধা দেওয়া হবে সেখানেই অবস্থান নিয়ে অনশন কর্মসূচি শুরু করব।

এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির মহাসচিব শেখ আবদুস ছালাম মিয়া বলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা এক হওয়া সত্ত্বেও সরকার প্রধান শিক্ষকদের চেয়ে তিন ধাপ নিচে সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল নির্ধারণ করে আমাদের মধ্যে আর্থিক ও মর্যাদাগত বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এতে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের অগ্রগতি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তিনি বলেন, সরকার সহকারী শিক্ষকদের দাবি না মানলে আগামী মাসের শুরু থেকে কর্মবিরতি এবং রাজপথে অবস্থানের মতো কঠোর কর্মসূচি শুরু করব আমরা।

বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি একেএম খসরুজ্জামান বলেন, এ মাসের মধ্যেই দাবির বিষয়ে কোনো ঘোষণা না এলে আগামী ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করব।

সিরাজগঞ্জ কাজিপুর বড়ইতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আমিনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সরকার আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কাটিয়ে দ্রুত দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দিয়ে নতুন স্কেলে বেতন-ভাতা দেওয়া শুরু না করলে আগামী মাসে আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব আমরা।

সহকারী শিক্ষকরা বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের মাঝে বেতনের ব্যবধান করেছিলেন মাত্র ১০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে মূল বেতনের ব্যবধান ১ হাজার ২০০ টাকা। আগে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের মধ্যে বেতন স্কেলের ব্যবধান ছিল এক ধাপ যা বর্তমানে তিন ধাপ ব্যবধানে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জাতীয় বেতন স্কেলের ১১তম গ্রেডে ৬ হাজার ৪০০ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকগণ জাতীয় বেতন স্কেলের ১৪তম গ্রেডে ৫ হাজার ২০০ টাকা পান। এই স্কেলে সহকারী শিক্ষকরা ১৫ বছর চাকরি করার পর তিনটি টাইম স্কেল পেয়ে সদ্য যোগদান করা একজন প্রধান শিক্ষকের সমান বেতন স্কেল পাবেন। আর ১৫ বছর পর সিলেকশন গ্রেড এবং টাইম স্কেল পেয়ে একজন প্রধান শিক্ষক পাবেন ১২ হাজার টাকার বেতন স্কেল। এর মধ্যে নতুন জাতীয় বেতন কাঠামো অনুযায়ী, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ দেওয়া হলে প্রধান ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে এই বৈষম্য আরও অনেক বেড়ে যাবে। তাই প্রধান শিক্ষকদের এক ধাপ নিচের গ্রেডে সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল নির্ধারণ করে উভয় পদকে একই অর্থাৎ দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দিতে হবে।

অন্যান্য দাবির মধ্যে রয়েছে-অবিলম্বে প্রধান শিক্ষক পদে সরাসরি নিয়োগ বন্ধ করে শতভাগ পদোন্নতি, সহকারী শিক্ষক পদটিকে এন্ট্রি পদ ধরে মহাপরিচালক পর্যন্ত পদোন্নতি, সহকারী নতুন শিক্ষক নিয়োগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষাগত যোগ্যতার বিধান চালু, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বহাল রেখে ৪০ ভাগের পরিবর্তে শতভাগ পেনশন সুবিধা, প্রাথমিক ডিপার্টমেন্টকে নন-ভোকেশনাল ডিপার্টমেন্ট হিসেবে ঘোষণা, শিক্ষকদের জন্য উন্নতমানের পর্যাপ্ত রেশন ও আজীবন চিকিত্সা বীমার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।



মন্তব্য চালু নেই